নিষেধাজ্ঞা ইস্যুতে তৎপর সরকার : সতর্ক থাকতে রাষ্ট্রদূতদের চিঠি
মিথ্যা প্রচারণায় ঢাকার নির্দেশনার দিকে তাকিয়ে না থেকে সরাসরি ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ
স্টাফ রিপোর্টার: র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে সরকার। সেই সঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের অপ্রীতিকর ঘটনা ঢাকা-ওয়াশিংটন টানাপড়েনে বাড়তি উত্তেজনা এনেছে। এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও নিষেধাজ্ঞাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে সরকারবিরোধীরা। এমন বাস্তবতায় নিষেধাজ্ঞার মতো পরিস্থিতি ঠেকাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার লিখিত নির্দেশনা দিয়েছে সরকার।
পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সচিব) মাসুদ বিন মোমেন গত ৩১ ডিসেম্বর বিদেশের মিশনগুলোতে চিঠি দিয়ে রাষ্ট্রদূতদের এই নির্দেশনা দেন। চিঠি পাঠানোর একদিন পর গত ১ জানুয়ারি ভার্চুয়াল বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনও রাষ্ট্রদূতদের একই আহ্বান জানান। সেই সঙ্গে সরকারবিরোধী অপপ্রচার ঠেকাতেও রাষ্ট্রদূতদের ভূমিকা রাখার নির্দেশনা দেন। এদিকে, র্যাব ও এই বাহিনীর কর্মকর্তাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে কাজ করছে সরকার। এরই মধ্যে লবিস্ট ও পিআর নিয়োগের কথাও বলা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আইন বিভাগের তথ্য অনুসারে, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরতে লবিস্ট হিসেবে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান নেলসন মুলিনস রিলে অ্যান্ড স্কারবোরো এলএলপি, বিজিআর পাবলিক রিলেশন, নুরনবার্গার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েশন, পোটোম্যাক স্কয়ার গ্রুপ ও আইস মিলার এলএলপি।
সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও রাজস্ব দপ্তর। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারকে চাপে রাখতে ফের এমন নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এক তরফা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার অস্বস্তির মধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকেও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে। এসব দেশ ও জোটগুলো ছাড়াও নির্বাচন এবং রাজনীতি নিয়ে কথা বলছে জাপান, জার্মানিসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ।
বিরোধী দলগুলোও দেশে-বিদেশে সরকার ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে বক্তব্য দেয়ার পাশাপাশি রীতিমতো লবিং করছে। তাই বাংলাদেশের মিশনগুলোতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো ২০২৩ সালের কর্মতালিকায় অগ্রাধিকার রয়েছে নিষেধাজ্ঞা প্রতিরোধের বিষয়টি।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের পররাষ্ট্র সচিবের পাঠানো ৭ পৃষ্ঠার কর্মতালিকার চিঠিতে মোট ২৪টি বিষয় তুলে ধরা হয় এবং ৭টি বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। ফের নিষেধাজ্ঞা ঠেকাতে বাড়তি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, আগামীতে ব্যক্তি কিংবা সংস্থার ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। তাই সর্বোচ্চ সতর্ক ও সজাগ থাকার পাশাপাশি ক্ষতিকর পদক্ষেপ প্রতিরোধেও সর্বদা প্রস্তুত থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এতে আগামী নির্বাচনের আগে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পাশাপাশি বেশ কিছু বিষয়ে নজর রাখার নির্দেশ দেয়া হয়।
চিঠিতে কোনো দেশের নাম উল্লেখ করা না হলেও পশ্চিমা দেশগুলোতে কর্মরত দূতদের বাড়তি সতর্ক থাকার তাগিদ দেয়া হয় বলে জানা গেছে। তাদেরকে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারেও সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
চিঠিতে র্যাবের নাম উল্লেখ না করে নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘আমাদের একটি বিশেষায়িত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও তার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ওপর একতরফা নিষেধাজ্ঞা এসেছে। সরকার ও তার প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে সরকারি সংস্থা-ব্যক্তির ওপর একই প্রেক্ষাপটে বা অন্য কারণে আরও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এ জন্য নিষেধাজ্ঞা ঠেকাতে প্রস্তুত থাকার লক্ষ্যে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি সময় অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। সময়ে সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আপনাদের হালনাগাদ তথ্য ও নির্দেশনা দেবে।’
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, যে কোনো কূটনীতিক মিশনের মৌলিক কাজ হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বজায় রাখার মধ্য দিয়ে দৈনন্দিন কাজ এগিয়ে নেয়া। তবে বর্তমান বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আরও বাড়তি কাজের চাহিদা রয়েছে।
র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও সম্প্রতি দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে ঢাকায় সংঘটিত এক অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়েও ওয়াশিংটন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মার্কিন দূতসহ কূটনীতিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করলেও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে সরকার। গত ১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমন্বয় সভায়ও এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। ওই সভায় অংশ নেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবিড় করার পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে কেউ যাতে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে না পারে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকার ব্যাপারে একমত হন। ঢাকা-ওয়াশিংটন ইস্যুতে সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে অভিন্ন সূরে কথা বলার ব্যাপারেও একমত হন তিন মন্ত্রী।