গাংনীতে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে সিজারিয়ানের সংখ্যা
প্রয়োজন ছাড়াই কতিপয় চিকিৎসক ও পরিবার বেছে নিচ্ছেন এ পদ্ধতি
স্টাফ রিপোর্টার: মেহেরপুরের গাংনীতে সিজারিয়ান বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের হার বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। প্রয়োজন ছাড়াই কতিপয় চিকিৎসক ও পরিবার বেছে নিচ্ছেন এ পদ্ধতি। এখন শতকরা ৭৫ ভাগেরও বেশি শিশু অস্ত্রোপচার অর্থাৎ সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে জন্ম নিচ্ছে। সিজারিয়ান বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বেসরকারি ক্লিনিকের অর্থলিপ্সা, সরকারি ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু না হওয়া এবং ডাক্তারদের নৈতিকতার ঘাটতি ছাড়াও মা ও তার পরিবারের অসচেতনতাকে দায়ী করছেন বিজ্ঞজনরা। এতে যেমন বাড়ে প্রসূতির স্বাস্থ্যঝুঁকি, তেমনি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর বড় রকমের অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করছে। গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বিভিন্ন ক্লিনিকের হিসাব অনুযায়ী গত ৬ মাসে এ উপজেলায় ২৯৭ জন শিশুর ভূমিষ্ঠ হয়। এদের মধ্যে ১৮৭ জনের ভূমিষ্ঠ হয় সিজারিয়ানের মাধ্যমে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোনো সিজারিয়ানের ঘটনা না থাকলেও ক্লিনিকগুলোতে এসব সিজারিয়ান করা হয়। সিজারিয়ানের পর প্রসূতি মায়েদের শরীরে দেখা দিয়েছে নানা জটিলতা। পরবর্তী সন্তান ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। তারপরও মা যদি সুস্থও হয়ে ওঠে সার্জারির পরে তাও পরবর্তী সন্তান ধারণে যথেষ্ট ঝুঁকি থেকে যায়। এই ধরনের সার্জারি ইউটেরাস বা জরায়ুকে দুর্বল করে ফেলে। একবার সিজার করলে পরবর্তীতেও সিজার করতে হয়। অনেক সময় জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হয়। প্রস্রাবের থলিও ফেটে যায়। অনেক সময় এত রক্তপাত হয় যে মাকে আর রক্ষা করা যায় না। কী কারণে সিজারিয়ানের সংখ্যা বাড়ছে তা অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে কয়েকটি কারণ। প্রথমত, বেশি বয়সে বিয়ে, গর্ভবতী মায়েরা বা তার পরিবারের ইচ্ছা, অনুকরণ ও বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের প্রবণতা। অনেক পরিবার বা মা আছেন তারা সন্তান প্রসবের জন্য কষ্ট করতে চান না। কোনো কারণ ছাড়াই সিজারিয়ান করাতে চান। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকদের কিছু করার থাকে না। অন্যদিকে বহু বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের একমাত্র অর্থ উপার্জনের উপায় হচ্ছে সিজারিয়ান। উপজেলার কুঞ্জনগর গ্রামের ইমাদুল হক জানান, মাস দেড়েক আগে তার স্ত্রীকে সিজারিয়ান করানো হয়। প্রথম থেকেই তার স্ত্রীর মাজায় ব্যথা ছিলো। পরে রক্ষক্ষরণ শুরু হয়। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞ বলেছেন, তার জরায়ু ফেটে গেছে। কেটে ফেলতে হবে। গর্ভবতী থাকাকালীন ডাক্তার বলেছিলেন স্বাভাবিক সন্তান প্রসব হবে কিন্তু সন্তান প্রসবের সময় জটিলতার কথা বলে অপারেশন করানো হয়। সিজারিয়ান থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত অন্তত লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তবুও সুস্থ হয়নি স্ত্রী তাহমিনা। ছাতিয়ানের আমজাদ হোসেন জানান, তার স্ত্রীর সামান্য জটিলতা ছিলো। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার নরমাল ডেলিভারির কথা বলে। কিন্তু প্রতিবেশীদের কথা শুনে স্ত্রী রহিমা সিজারিয়ানের জন্য সম্মতি দেন। সিজারিয়ান অপারেশন করার পর মাসখানেক ভালো থাকলেও এখন নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অনিয়মিত মাসিক স্র্রাব, তলপেট ব্যথা ও বহুমূত্র রোগ দেখা দিয়েছে। আর কোনো সন্তান নেয়া যাবে না বলেও চিকিৎসকরা জানান। আবার সন্তান নিলেও দেরিতে নিতে হবে এবং সেটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হবে। বালিয়াঘাটের গৃহবধূ আঁখি বেগম জানান, সন্তান প্রসবে অনেক কষ্ট হয় বলে তার বান্ধবীর কাছ থেকে শুনে সিজারিয়ান করানো হয়। এখন কোনো কাজ করতে পারছি না। নিজের কাজ করতে পারছি না, সন্তানের কোনো যত্নও নিতে পারছি না। সংসারের কাজকর্ম করতে না পারায় কটু কথাও শুনতে হচ্ছে। গাংনী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডা. আদিলা আজহার আরশী জানান, সিজারিয়ান কোনোমতেই স্বাভাবিক প্রসবের বিকল্প হতে পারে না। আবার আধুনিকতার নিরিখে প্রসবের সময় ব্যথাও কোনোমতে কাম্য নয়। এ ধরনের ডেলিভারি মা এবং শিশু দুইজনকেই ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়। অনেক গর্ভবতী মা প্রায়ই ব্যথা আতঙ্কের কারণে সন্তান প্রসব করার জন্য অস্ত্রোপচার করতে বাধ্য হন। তবে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করার পরেও তাদের প্রসব পরবর্তী দীর্ঘ মেয়াদি বিভিন্ন জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার (ইউএইচ অ্যান্ডএফপিও) সুপ্রভা রানী জানান, এটি শুধু একটি অপারেশন নয়, রোগীকে অজ্ঞান করতে হয়। ফলে তার ঝুঁকি বেড়ে যায়। একবার সিজার করলে পরবর্তীতেও সিজার করতে হয়। অনেক সময় জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হয়। প্রস্রাবের থলিও ফেটে যায়। অনেক সময় এত রক্তপাত হয় যে মাকে আর রক্ষা করা যায় না। কারো কথায় কান না দিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডেলিভারি করানো উচিত। স্বাস্থ্য বিভাগ প্রসূতিদের এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছে। আগামীতে সিজারিয়ানের সংখ্যা কমে যাবে।