জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জোট রাজনীতিতে মেরুকরণ
ছোট দলকে কাছে টানছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি
স্টাফ রিপোর্টার: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জোট রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হচ্ছে। ছোট ছোট দলগুলোকে কাছে টানছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। নিজেদের বলয়ের শক্তি সুসংহত করতে প্রকাশ্যে এবং পর্দার আড়ালে ছোট দলগুলোর সঙ্গে দরকষাকষি করছে বড় দল দুটি। আবার সুযোগ বুঝে পাল্টা কৌশল নিচ্ছে ছোট দলগুলোও। বড় দলের কাছ থেকে জোটগত ‘সুবিধা’ আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে নিজেরাও। কিছুদিন ধরেই ছোট দলগুলোর মধ্যে চলছে আলাদা আলাদা জোট গঠনের তোড়জোড়। জোটবদ্ধ হয়ে ‘শক্তি’ দেখাতে চাচ্ছে তারা। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ৩৯ রাজনৈতিক দলের কিছু দল এবং অনিবন্ধিত বেশ কিছু দল আলাদা জোট গঠনে তৎপর রয়েছে। এক জোট থেকে অন্য জোটে ভিড়ছে কোনো কোনো দল। আবার কেউ নিজেদের দল ভেঙে দুই ভাগ হয়ে যোগ দিচ্ছে দুই জোটে।
এ পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিনের মান-অভিমান নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। অতীতের ভুলত্রুটি, অবহেলা ও বঞ্চনা ভুলে দেশ, জনগণ ও গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থে স্ব স্ব বলয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে তারা। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে যথাযথ মূল্যায়ন এবং নির্বাচনে সম্মানজনক আসন বণ্টনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে দল দুটি।
আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে টানাপোড়েন কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। জোটের বাইরে সমমনা ছোট দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে। নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরকে গণভবনে ডেকে একান্ত কথা বলেছেন তিনি। একই সঙ্গে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। তবে গেল নির্বাচনে বিএনপির জোটের সঙ্গেই ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন তিনি। তাদের কিছু দাবি-দাওয়া পূরণের ব্যাপারেও তিনি আশ্বাস দেন। একই সঙ্গে পর্দার আড়ালে আরও বেশ কিছু দলের সঙ্গেও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা যোগাযোগ করছেন।
অন্যদিকে সরকারবিরোধী নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপিও। নির্দলীয় সরকারের অধীনে দাবিসহ ১০ দফা এবং ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখা বাস্তবায়নের ভিত্তিতে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ইতোমধ্যে সাড়া দিয়েছে সরকারবিরোধী বেশ কিছু দল। ৭ দলের সমন্বয়ে গঠিত গণতন্ত্র মঞ্চ বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ভেঙে সরকারবিরোধী নতুন দুটি জোট হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১২ দলীয় একটি জোট আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আগামী ২৮ ডিসেম্বর আত্মপ্রকাশ করবে ১০ দলের সমন্বয়ে জাতীয়তাবাদী ঐক্যজোট।
আবার আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি বলয়ের বাইরে বাম ও প্রগতিশীল পাঁচটি দলের সমন্বয়ে আত্মপ্রকাশ করবে দ্বিদলীয় ‘বিকল্প শক্তি’।
বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে ৩৯টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগসহ ও তাদের নেতৃত্বাধীন জোট এবং সমমনা নিবন্ধিত রয়েছে ১৪টি দল। এর মধ্যে ১৪ দলীয় জোটে নিবন্ধিত রয়েছে ৮টি। সমমনা দল রয়েছে আরও ৪টি এবং ধর্মভিত্তিক ২টি দল। সরাসরি রাজনৈতিক দল না হলেও ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামেরও আওয়ামী লীগের সঙ্গে রয়েছে সুসম্পর্ক। এছাড়া ৬টি অনিবন্ধিত দলসহ সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত মোট ২০টি দল রয়েছে আওয়ামী লীগের সমর্থনে।
বিএনপিসহ তাদের নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি পালনে ঐকমত্য পোষণকারী নিবন্ধিত দল ৭টি। অনিবন্ধিত আরও ২৬টি দল রয়েছে বিএনপির সঙ্গে। ইতোমধ্যে মোট ৩৩টি সমমনা দল বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চের ৭ দল, ১২ দলীয় জোট ঘোষণা করেছে। আগামী বুধবার ঘোষণা করবে জাতীয়তাবাদী সমমনা ঐক্যজোট।
এছাড়া বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বলয়ের বাইরে বাম ও প্রগতিশীল ‘বিকল্প শক্তি’র জোটে ৩ দল, কোনো জোটে নেই ধর্মভিত্তিক ইসলামী ৬টি দল এবং জোটবদ্ধ নয় এমন আরও ৮টি নিবন্ধিত দল রয়েছে। এ দলগুলো এখনও কোনো দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ ও যুগপৎ কর্মসূচি ঘোষণা করেনি।
১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, সাম্প্রদায়িক শক্তি ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি মোকাবেলায় ১৪ দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধ কাজ করছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আমরা সক্রিয় রয়েছি। জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা মোকাবিলা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে রেখে জোট গঠন হয়েছে। এ আদর্শে বিশ্বাসী আরও যেসব দল রয়েছে তারাও ১৪ দলের সঙ্গে একত্রে দেশকে এগিয়ে নিতে কাজ করতে পারে। আমরা তাদের স্বাগত জানাব।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, দেশে আজ গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও মানবাধিকার নেই বললে চলে। রাষ্ট্রের প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এ পরিস্থিতিতে জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা এবং ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্র মেরামতে ২৭ দফা রূপরেখা দিয়েছি। ইতোমধ্যে বিএনপির এ দাবি ও রূপরেখার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে ৩৩টি রাজনৈতিক দল। দাবি আদায়ে তারা বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচি পালনেরও ঘোষণা দিয়েছে। আমরা দেশপ্রেমিক অন্য রাজনৈতিক দলকেও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এ আন্দোলনে শামিল হওয়ার আহ্বান জানাব।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট: ১৪ দলীয় জোটে কার্যত ১৩ দল ছিল। সম্প্রতি শরীফ নূরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদ বেরিয়ে যাওয়ার পর বর্তমানে আছে ১২ দল। এর মধ্যে নিবন্ধিত আটটি। আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি নিবন্ধিত দলগুলো হচ্ছে-রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), দিলীপ বড়–য়ার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দল, ব্যারিস্টার মো. আরশ আলীর নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্রী পার্টি, আমিনা আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (মোজাফফর), আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি-জেপি ও সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারির নেতৃত্বাধীন তরীকত ফেডারেশন। অনিবন্ধিত চারটি দল হচ্ছে- এসকে সিকদারের নেতৃত্বাধীন গণআজাদী লীগ, জাকির হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খানের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট কেন্দ্র এবং রেজাউর রশীদের নেতৃত্বাধীন বাসদ (রেজাউর)।
সরাসরি জোটে না থাকলেও আওয়ামী লীগের সমমনা দল সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টিও সম্প্রতি নিবন্ধিত কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও জামায়াত ভেঙে গড়া অনিবন্ধিত এবি পার্টিকে নিয়ে আলাদা জোট গঠনের চেষ্টা করেছিল। দু’দলের সঙ্গে বৈঠকও করেছিল। শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি।
এর বাইরে কোনো জোটে না থাকলেও আওয়ামী লীগের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে অধ্যাপক ডা. বদরুদোজ্জা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা ও বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ)।
ধর্মভিত্তিক দলের মধ্যে সরাসরি জোটে না থাকলেও আওয়ামী লীগের সমর্থনে রয়েছে নিবন্ধিত দুটি দল। দলগুলো হলো- বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ও ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ। এরা আহলে সুন্নাত ও মাজারপন্থি দল হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া অনিবন্ধিত দলের মধ্যে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বাধীন তৃণমূল বিএনপিও আওয়ামী লীগের সমমনা হিসেবে পরিচিত। দলটিকে নিবন্ধন দিতে ইতোমধ্যে উচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছেন।