নিজের বাল্যবিয়ে রুখে দেয়া চুয়াডাঙ্গার বর্ষা পেলো জিপিএ-৫
মুড়ি কারখানায় কাজ করে মেয়েকে পড়াচ্ছেন মা বিউটি খাতুন
আফজালুল হক: বছরখানেক আগে থানায় হাজির হয়ে শ্রাবন্তী সুলতানা (বর্ষা) নিজের বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছিলো। সেই সাহসী কিশোরী এবারের এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। চুয়াডাঙ্গা শহরের ঝিনুক মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলো শ্রাবন্তী। ওই বিদ্যালয় থেকে ১৯ জন পরীক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে শ্রাবন্তীকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসার কথা ছিলো। শ্রাবন্তী তখন দশম শ্রেণির ছাত্রী। বাল্যবিবাহ আয়োজনের বিষয়টি বুঝতে পেরে সে ছুটে গিয়েছিলো সদর থানায়। একটি লিখিত আবেদন করেন তিনি। সেখানে সে উল্লেখ করে, ‘আর্থিক দুরবস্থার কারণে বিয়ে দেয়া সব সমস্যার সমাধান নয়, বরং বাল্যবিবাহের কারণে আমাদের দেশে হাজারো মেয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় এবং একপর্যায়ে অপমৃত্যুর শিকার হয়।’ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীনকে শ্রাবন্তী বলেছিলো, ‘বাল্যবিবাহ নয়, আমি পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। আপনারা সঙ্গে থেকে সহযোগিতা করলে কেউই আমার উচ্চশিক্ষা ঠেকাতে পারবে না।’ পরে মেয়েটির সাহসী ভূমিকায় বিয়ের আয়োজন ভেস্তে যায়। ওসি ছাত্রীটির মা সহ পরিবারের সদস্যদের ডেকে বিয়ের আয়োজন বন্ধ করতে বলেন। শ্রাবন্তীকে নিয়ে প্রথম আলোতে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর জেলা প্রশাসন ও মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নিতে জেলা প্রশাসন থেকে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে শিক্ষা সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়। স্কুলে যাতায়াতের খরচের বিষয়ে ওসি মোহাম্মদ মহসীন সহযোগিতা করেন। মা-বাবার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটায় শ্রাবন্তীর মায়ের সঙ্গে সদর উপজেলার আলুকদিয়া ইউনিয়নে নানাবাড়িতে থাকে। তার বাবা ও বড় ভাই থাকেন যশোরে। শ্রাবন্তীর মা বিউটি খাতুন একটি মুড়ির কারখানায় কাজ করেন। মেয়ের সাফল্যে শ্রাবন্তীর মা বিউটি খাতুন আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, ‘আমার যত কষ্টই হোক, মেয়েকে সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে যা যা করার সবই করবো।’ শ্রাবন্তীর এই সাফল্যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন ঝিনুক মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শ্রাবন্তীর সহপাঠিরা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেবেকা সুলতানা বলেন, ‘সে নিজের ও প্রতিষ্ঠানের জন্য গৌরব বয়ে এনেছে। মূলত আর্থিক সমস্যার কারণে বাল্যবিবাহ হয়ে থাকে। আবার কখনো সামাজিক কারণেও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে থাকে। যদিও আমাদের দেশে বাল্যবিবাহ সাংবিধানিক ও সামাজকিভাবে একটা অপরাধ। এ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও এটি পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। তবে শ্রাবন্তীর এই সাফল্য ও সাহসী মনোবল অনেক মেয়ের সামনে বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে।’
তৎকালীন চুয়াডাঙ্গা সদর থানা এবং বর্তমান ঢাকা উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, রেজাল্ট দেয়ার পরই বর্ষাকে অভিনন্দন জানিয়েছি। তাকে এখনো ভুলিনি। বাল্যবিবাহ বন্ধে থানায় আসার জন্য অনেকে সমালোচনা করেছিলো। এটা হলো সেই সমালোচকদের জবাব। এ রকম বর্ষাদের পাশে থাকলে তারা জাতির একটা গুরুতপূর্ণ জায়গায় যেতে পারবে। আজকে আপনাদের মাধ্যমে সবাই জানবে মেয়েরা সাহসী হলে সব সম্ভব। বর্ষার জন্য শুভকামনা। আমার স্বপ্ন সে চিকিৎসক হবে। আমি তার পাশে থাকবো। এর আগে ২০২১ সালের ২৫ সেপ্টম্বর চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন বাল্যবিবাহ ভেঙে ওই শিক্ষার্থীর পড়াশোনার দায়িত্ব নেন। তা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারের পর উৎসাহিত হয়ে ২৮ সেপ্টেম্বর ওসির কাছে নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকাতে লিখিত অভিযোগ জানায় বর্ষা। ওসি বর্ষাকে সাধুবাদ জানিয়ে তার বিয়ে বন্ধ করে দেন। এরপর স্কুলছাত্রী বর্ষাকে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসন ও জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জাতীয় কন্যা শিশু দিবসের অনুষ্ঠানে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। একই সঙ্গে তাকে ‘সাহসী কন্যা’ উপাধি দেয়া হয়।