স্টাফ রিপোর্টার: চার বছর আগে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যান রাজধানীর রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও মীম। সেই ঘটনার সূত্র ধরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে নেমে আসে লাখো শিক্ষার্থী। আন্দোলনের মুখে পাস করা হয় ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’। কিন্তু চার বছর পার হলেও আইন বাস্তবায়নে নেই কার্যকর উদ্যোগ।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘সড়ক পরিবহন আইন পাসের চার বছর পূর্ণ হলেও তা বাস্তবায়নে বিধিমালা তৈরি হয়নি। ফলে সড়ককে নিরাপদ করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও আইনের বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বেসরকারি সংগঠনগুলো গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে দুর্ঘটনার প্রতিবেদন তৈরি করে। এ সবই সেকেন্ডারি তথ্য, পূর্ণাঙ্গ তথ্য নয়। সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্ব বেসরকারি সংগঠনের না। এ প্রতিবেদন সরকারের করা উচিত।’ ব্রাকের রোড সেফটি প্রোগ্রামের (প্রোজেক্ট) ম্যানেজার এম. খালেদ মাহমুদ বলেন, সড়ক পরিবহন আইনের কিছু সবল দিক থাকলেও এর অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আইনটিতে হেলমেট ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এর মানদ- ও ব্যবহারবিধি আইনে অনুপস্থিত। আইনে গতিসীমা লঙ্ঘনে শাস্তির বিধান থাকলেও গতিসীমা নির্ধারণ, এর বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণের নির্দেশনা ও গাইডলাইন নেই। যা বাস্তবায়ন অযোগ্য। এছাড়া যাত্রীদের সিটবেল্ট ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা, শিশুদের জন্য নিরাপদ বা সুরক্ষিত আসন ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা আইনটিতে সংযোজন করা হয়নি। ফলে সড়ককে নিরাপদ করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও আইনের বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’ আইন কার্যকরের আগেই শাস্তি, কারাদন্ডের বিধান কমিয়ে এবং অজামিনযোগ্য অপরাধকে জামিনযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করে সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। আইনটির সংশোধন আটকে থাকায় তৈরি হচ্ছে না বিধিমালা। যদিও সংসদে পাস হওয়ার পর ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর এর গেজেট জারি করা হয়। ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর থেকে সরকার এ আইন কার্যকরের ঘোষণা দেয়। মোট ১২৬টি ধারার মধ্যে ২৯টি ধারায় পরিবর্তন এনে সংশোধিত আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হয়। পরে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত নিতে গত বছরের মে মাসে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে খসড়াটি তোলা হয়। সেখান থেকে সংশোধিত খসড়া প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে রয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মতি পাওয়ার পর খসড়াটি সড়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হবে। সেখান থেকে বিল আকারে সংসদে উপস্থাপন করা হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি ২০১৮-এর তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ ৩৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় সড়ক দুর্ঘটনায়। বিশ্বব্যাপী শতকরা ৯০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশসমূহে। যা উন্নত দেশসমূহের তুলনায় তিন গুণ বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতিবছর জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে আলোচনা চলে আইন বাস্তবায়ন নিয়ে। কয়েক দিন পার হলেই আবার ঝিমিয়ে যায়। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, দেশে প্রচলিত একটা প্রবাদ বাক্য আছে ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার। সড়ক পরিবহন আইনের শক্তি হলো তার বিধিমালা। বিস্তারিত থাকবে বিধিমালায় কিন্তু সেটাই তৈরি করা হয় নি। আইনটা দীর্ঘদিন আইন মন্ত্রণালয়ে ছিল। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করার পর দ্রুত আইন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। তারপরেও গেজেট করা হয়েছিল না। আমরা আদালতে যাওয়ার পর গেজেট করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও আইন কার্যকর করা হয়নি। তাহলে বোঝা যায়, তারা কতটা শক্তিশালী। তিনি আরও বলেন, ‘ঠিক একইভাবে বিধিমালাও করছি করব করে পেছানো হচ্ছে। এটার সঙ্গে বাস মালিক ব্যবসায়ীদের স্বার্থ জড়িত। সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও ভালো। তাদের নেতারা দলীয় হিসেবে সরকারের সমর্থক। এজন্য সরকারও তাদের ওপর কঠোর হতে পারে না। ফলে তারা এ সুযোগগুলো পাচ্ছে।’