স্টাফ রিপোর্টার: দেশে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছিল রেকর্ড পরিমাণ। কমেছে সামান্য। তাতে সাধারণ মানুষের কোনো সুবিধা দেখছেন না জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। লাভ হবে ব্যবসায়ীদের। সব ধরনের জ্বালানি তেলে দাম লিটারে ৫ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তকে জ্বালানি বিভাগের এক ধরনের তামাশা বলে মনে করছেন তারা। তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে কমার লক্ষণ দেখছেন না তারা। দেশে ইতিমধ্যে উচ্চহারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশচুন্বী হয়েছে। পরিবহন ভাড়া বেড়েছে। ৫ টাকা কমানোকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতার একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ বলছেন অর্থনীতিবিদরা। সব প্রকার জ্বালানি তেলে দাম লিটারে ৫ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তকে লোক দেখানো বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কেমিক্যাল বিভাগের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন। এই দাম নির্ধারণকে সম্পূর্ণ অর্থহীন বলে মনে করেন তিনি। সাধারণ জনগণের কোনো উপকারেই আসবে না এতে। জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা কমলো-এতে সাধারণের কি সুবিধা হলো জানতে চাইলে দেশের খ্যাতিমান এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, এতো কম টাকা কমানো হয়েছে তাতে কোনো জিনিসপত্রের দামে এর প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, দাম কমে এমন একটা পরিবর্তন করা উচিত ছিল, যা পরিবহনে পরিবর্তন, সেচে অবদান রাখতে পারতো। সব জায়গায় সুবিধা পেতো। এখন শুধু ব্যবসায়ীদের সুবিধা হয়েছে। যারা সরাসরি ডিজেলের ব্যবসা করে তাদের পকেটে লাভ যাবে। ড. ইজাজ হোসেন বলেন, এটা প্রশাসনিক প্রাইসিং হয়েছে। এতে সরকার রাজস্ব পাবে না। ব্যবসায়ী গ্রুপের পকেট ভারী হবে।
জ্বালানি তেলের লিটারে ৫ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তকে তামাশা হিসেবে দেখছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম। এতে সাধারণ ভোক্তাদের কোনো লাভ হবে না। ব্যবসায়ীদের পকেট ভারী হলো। কমানোর সুফল পুরোটাই ব্যবসায়ীদের পকেটেই যাবে। গতকাল তিনি মানবজমিনের সঙ্গে আলাপকালে এমন মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, অবৈধ উপায়ে দাম বাড়ানো যেমন ভোক্তা স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য নয়, তেমনি অবৈধ উপায়ে দাম কমানোও ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ করে না। ড. এম শামসুল আলম বলেন, অবৈধ উপায়ে দাম বাড়িয়ে আবার কমানো মানুষকে বিভ্রান্ত করার নামান্তর। এ ধরনের সিদ্ধান্ত? বিপিসি’র অনৈতিক ও লুণ্ঠনমূলক মুনাফা করার যে প্রবণতা, সেটিকে জিইয়ে রাখবে। বিপিসি যে তার মুনাফা বাড়ানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে, তার প্রমাণ আমরা ইতিমধ্যেই পেয়েছি। ১৫টি ব্যাংকে ২৫ হাজার কোটি টাকা ডিপোজিট করেছে তারা, ব্যবসা করছে, বিনিয়োগ করছে। একটা কোম্পানির ২৫ হাজার কোটি টাকা এভাবে সঞ্চয় হয়ে যায়, যা খরচের কোনো জায়গা নেই। এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, আমাদের কাছ থেকে একটি জাতীয় কোম্পানি (বিপিসি)-সেটি তো আমাদেরই কোম্পানি- আমাদের কাছ থেকে ন্যায্য ও যৌক্তিক মূল্য অপেক্ষা বেশি টাকা নিচ্ছে, কতো নিয়েছে সেটা আমরা এখনো জানি না।
ভর্তুকি প্রত্যাহারের অজুহাতে এর আগেরবারও তারা (বিপিসি) এতটা দাম বাড়িয়েছে, আর এখন কমানোটাও তাদের একই প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা। তাদের ওই সিদ্ধান্তটিকে টেকসই করার জন্য লোক দেখানোভাবে ৫ টাকা কমিয়েছে। ৫ থেকে ৬ বছর আগেও লোক দেখানোর জন্য ৩ টাকা কমানো হয়েছিল। যদিও তখন ৩ টাকার একটা মূল্য ছিল, এখন ৫ টাকার তো কোনো মূল্যই নেই, ফকিরকে ভিক্ষাও দেয়া যায় না। অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, যে বিবেচনায় এটা করা হয়েছে, সেটা কতোটা সুবিবেচনার, কতোটা অবিবেচনার, সেটি ভোক্তারা বিবেচনা করবেন। আমি শুধু এতটুকুই বলতে চাই যে, জনস্বার্থে যদি মূল্য বাড়ানো বা কমানোর প্রয়োজন হয়, তবে কেন তারা কমিশনের (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) কাছে যায় না। রাতের অন্ধকারে চার দেয়ালের মধ্যে নিজের মতো করে হিসাব-নিকাশ করে স্বার্থ-সংঘাতভাবে এ সিদ্ধান্ত কেন নেয়? জ্বালানির দাম বৃদ্ধির পর অন্যান্য যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে, তা যে আর কমবে না, সেটা অবধারিত সত্য। ২০১৬ সালে ৩ টাকা কমানোর ফলে শুধু বাস মালিকরা ৯০০ কোটি টাকা লাভ করেছিল, এখন ৫ টাকা কমানোর ফলে তারা ভাড়া আর কতো কমাবে। ওই ৫ টাকাও তাদের পকেটেই ঢুকবে। মানে-দাম কমানোর সুফল পুরোটাই ব্যবসায়ীদের পকেটেই যাবে। আর দ্রব্যমূল্যের ওপর যে কী প্রভাব পড়বে, তা আমার বোধগম্য নয়।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেন দেশের অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয়। তিনি প্রশ্ন করেন ৪৪ টাকা নিয়ে ৫ টাকা ফেরতের ভিত্তি নিয়েও। ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৫ টাকা করে কমিয়েছে সরকার। কিন্তু ৪৪ টাকা নিয়ে ৫ টাকা ফেরতের সিদ্ধান্তের ভিত্তি কি? এই মুহূর্তে যে সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে, তার ভিত্তি কি? কে নিচ্ছে এসব সিদ্ধান্ত? তিনি প্রশ্ন করেন, এটা কি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না আর্থিক সিদ্ধান্ত? এটা কি সামাজিক সিদ্ধান্ত? সিদ্ধান্তগুলো কোথায় হচ্ছে? এটা কি মন্ত্রিপরিষদে হচ্ছে, এটা এনার্জি কমিশনে হচ্ছে, এটা মন্ত্রণালয়ে হচ্ছে নাকি ব্যক্তিগতভাবে হচ্ছে? না কোনো বিশেষ মহল এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে? এ সময় জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সিদ্ধান্তের জায়গা পরিষ্কার নয় দাবি করে তিনি বলেন, ৩৪ থেকে ৪৪ টাকা নিয়ে ৫ টাকা ফেরত, এটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতার একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ কোন জায়গা থেকে কতো ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছে? কতো অর্থের প্রয়োজন পড়ছে? তেলে কর আহরণ কতো? কিছুই কিন্তু জানি না। শুধু যদি একটি মন্ত্রণালয়, একজন সচিবের মাধ্যমে মধ্যরাতে সিদ্ধান্ত দেন যে, দুই সপ্তাহ পর এটা করতে হবে, তিন সপ্তাহ পর এটা করতে হবে, তাহলে এমনই হবে। এসব অস্থায়ী ভিত্তিতে নেয়া সিদ্ধান্তেরও সমালোচনা করেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
প্রসঙ্গত, নতুন দাম অনুযায়ী, ভোক্তা পর্যায়ে লিটারপ্রতি ডিজেল ১১৪ টাকা থেকে কমে ১০৯ টাকা, কেরোসিন ১১৪ টাকা থেকে ১০৯ টাকা, অকটেন ১৩৫ টাকা থেকে কমে ১৩০ টাকা এবং পেট্রোলের দাম ১৩০ টাকা থেকে কমে ১২৫ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। গত ৫ আগস্ট দিনগত রাত ১০টায় জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দেশের বাজারে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বেড়ানোর সিদ্ধান্ত জানানো হয়। ওইদিনই রাত ১২টার পর থেকে নতুন দাম কার্যকর হয়। তখন রেকর্ড পরিমাণে উচ্চহারে মূল্যবৃদ্ধি করে দিবাগত রাত ১২টার পর থেকে ভোক্তা পর্যায়ে লিটার প্রতি ডিজেল ৮০ টাকা থেকে ৩৪ টাকা বেড়ে ১১৪ টাকা, কেরোসিন ৩৪ টাকা বেড়ে ১১৪ টাকা, অকটেন ৪৬ টাকা বেড়ে ১৩৫ টাকা এবং পেট্রোল ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা দরে বিক্রি শুরু হয়। ২০২১ সালের ৪ঠা নভেম্বর ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়িয়েছিল সরকার। তখন এ দুই ধরনের জ্বালানির দাম লিটারপ্রতি ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়। তবে ওই সময় পেট্রোল ও অকটেনের দাম অপরিবর্তিত রাখা হয়েছিল। এর আট মাস পর গত ৫ই আগস্ট দেশের বাজারে সব ধরনের জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়।