মরদেহ নিয়ে সাত স্ত্রীর টানাটানি : শেষমেশ ভাইয়ের কাছে লাশ হস্তান্তর
রাজধানীর উত্তরায় গার্ডার পড়ে নিহত রুবেলের গ্রামের বাড়ি মেহেরপুরে শোকের মাতম
স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীর উত্তরার জসীমউদ্দিনে উড়ালসড়কের বক্সগার্ডার পড়ে চিড়ে চ্যাপ্টা প্রাইভেটকারে নিহত ব্যক্তি রুবেল হাসান (৬০) একাধিক বিয়ে করেছেন বলে জানা গেছে। গতকাল মঙ্গলবার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের সামনে এসে একে একে তার মরদেহ দাবি করছেন স্ত্রীরা। তাদের কয়েকজনের ঘরে রুবেল হাসানের সন্তান আছে বলেও দাবি উঠেছে। মর্গে গেলে স্বজনহারাদের কান্নার পাশাপাশি রুবেলের লাশ নিয়ে টানা-হেঁচড়া শুরু হয়। পাঁচজন নারী সেখানে উপস্থিত হয়ে রুবেলকে তাদের স্বামী বলে দাবি করেন। মারা যাওয়ার পর বেরিয়ে আসে রুবেল মোট সাতটি বিয়ে করেছেন। এর মধ্যে প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন। পঞ্চম স্ত্রীর সঙ্গে তার মামলা চলছে। তাদের কারও কারও সঙ্গে সন্তানরাও এসেছেন। ওই নারীদের একজন আরেকজনের বিয়ের ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন। রুবেল স্ত্রীদের কাছে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত ছিলেন। রুবেলের স্ত্রী দাবি করে হাসপাতালে আসা নারীরা হলেন-নার্গিস বেগম, রেহেনা বেগম, শাহিদা বেগম, সালমা আক্তার পুতুল ও তাসলিমা আক্তার লতা। এই পাঁচজন মর্গের সামনে এসে লাশ দাবি করেন।
মর্গের সামনেই শাহিদা জানান, তার বাড়ি মানিকগঞ্জের সিংগাইরে। ১৯৯৯ সালে পারিবারিকভাবে রুবেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তার ঘরে কলেজপড়–য়া এক মেয়ে রয়েছে। শাহিদা আরও বলেন, রুবেলের অন্য কোনো সংসার আছে তা আমার জানা ছিলো না। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতেই থাকতেন রুবেল। শনিবার রুবেল তাকে জানান, ঢাকায় এক বন্ধুর ছেলের বিয়েতে নিজের গাড়ি নিয়ে যাবেন। বর-কনে তার গাড়ি ব্যবহার করবেন। ওই গাড়ি একদিন ব্যবহারের জন্য রুবেলকে ৪ হাজার টাকা দেবেন বন্ধু। নিজের কয়েক দিনের পকেট খরচের টাকা হয়ে যাবে। দুর্ঘটনার পর জানতে পারলাম রুবেল তার নিজের ছেলের বিয়েতে গিয়েছিলেন। এই বিয়ের কথা কখনও তিনি জানাননি।
শাহিদার মেয়ে রত্না বলেন, বাবার সম্পদের জন্য অনেকে স্ত্রী হিসেবে দাবি করছেন। তার এতোগুলো স্ত্রীর কথা আমরা আগে জানতাম না, আজকে এসে জেনেছি।
তাসলিমা আক্তার লতা বলেন, ২০১৭ সালে রুবেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে। তার ঘরে কোনো সন্তান নেই। গাজীপুরে তার বাসায় রুবেল থাকতেন। মাঝেমধ্যে ব্যবসায়িক কাজে বাইরে যেতেন। আবার বাড়ি ফিরতেন।
সালমা আক্তার পুতুলের দাবি, তার বাসা মিরপুর ১০নম্বরে। রুবেলকে বিয়ে করার কিছুদিন পরই তিনি টের পান আরও একাধিক স্ত্রী রয়েছে তার। এরপর স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। ওই মামলায় হাজিরার সর্বশেষ দিন ছিলো ১১ আগস্ট। পুরান ঢাকায় নিম্ন আদালতে ওইদিন সর্বশেষ রুবেলের সঙ্গে তার দেখা যায়। মামলা তুলে নিতে তিনি পুতুলকে অনুরোধ করেন।
রুবেলের আরেক সন্তান দাবিদার নিপা আক্তার বলেন, সন্তান জন্মের সময় প্রথম স্ত্রী টিপুকে হারানোর পর রুবেল তার মা নার্গিসকে বিয়ে করেন। নিপা তার বাবার প্রথম সন্তান। পরে তার বাবা আরও ৬-৭টি বিয়ে করেছেন এটা তিনি জানতেন না। নার্গিসের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর বাবার সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ তার হতো না। সর্বশেষ মাস দুয়েক আগে বাবা ফোন করে তার খোঁজ নেন।
মর্গে অপেক্ষা করছিলেন রুবেলের ভাই ইয়াহিয়া। তিনি জানান, তারা ৯ ভাই, দুই বোন। মেহেরপুরের গ্রামের বাড়িতে রুবেল খুব একটা যেতেন না। তবে জানতেন ভাই ঢাকায় দুটি বিয়ে করেছেন। মর্গে এসে এতগুলো বিয়ের কথা শুনে তিনি রীতিমতো বিস্মিত। ইয়াহিয়া জানান, তার ভাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যবসা করতেন। কখনও জুটের কারবার, জমি বেচাকেনা, আবার কখনও বিদেশে লোক পাঠানো। ময়নাতদন্ত শেষে শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো জটিলতা ছাড়াই বিকেল ৫টার দিকে রুবেলের লাশ তার ভাইয়ের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়। স্ত্রী দাবিদার সবার সঙ্গে সমঝোতা করে গ্রামের বাড়ি মেহেরপুরে লাশ নেয়া হয়। অন্য চারজনের লাশ নেয়া হয় তাদের গ্রামের বাড়ি জামালপুরে।
আমাদের মেহেরপুরের বারাদী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কদিন আগেও বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন আইয়ুব আলী হোসেন রুবেল কথা ছিলো ছেলে ও পুত্রবধূকে নিয়ে বেড়াতে আসবেন। কিন্তু সেই কথা রাখতে পারলেন না। রুবেল এসেছেন ঠিকই তবে লাশ হয়ে।
রুবেলের গ্রামের বাড়ি মেহেরপুর সদর উপজেলার রাজনগর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শোকের মাতম চলছে। গ্রামের অনেকেই রুবেলকে নিয়ে আলোচনা করছেন। কেউ বা রুবেলের স্মৃতি রোমন্থন করছেন। সকলেই রুবেলের মরদেহের অপেক্ষায় রয়েছেন। রুবেলের বড় বোন আদুরি খাতুন ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর থেকেই মূর্ছা যাচ্ছেন। কথা বলতে পারছেন না। গলা বসে গেছে তার। তবুও ভাঙ্গা কণ্ঠে দুই হাত ও মাথা নাড়িয়ে আহাজারি করছেন।
আদুরি খাতুন বলেন, আমার স্বামী অনেক আগেই মারা গেছেন। আমার একটি মাত্র মেয়ে তাও বিয়ে হয়ে গেছে। আমার সংসারে রোজগার করার কেউ না থাকায় ভাই প্রতিমাসে সাত হাজার টাকা পাঠাতো। ওই টাকায় আমার সংসার চলতো। এখন আমার কী হবে? একইভাবে আহাজারি করছিলেন তার মেয়ে নাসিমা খাতুন। তিনি বলেন, মামা প্রতি ঈদেই বাড়ি আসতেন। আমাদের জন্য অনেক বাজার করে আনতেন। গ্রামের বাড়িতে এসে আমার মামা গ্রামের সকলের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতেন। রুবেলের বড় ভাই মহাশিন আলী বলেন, আমরা সাত ভাই, দুই বোন। রুবেল ৮ নম্বর। অনেক আগেই আমাদের বাবা এবং মা মারা গেছেন। আমি আমার ছোট ভাইদের মানুষ করেছি। বয়সের ভারে আমি তেমন আর চোখ দেখি না। ১০দিন আগেও রুবেল আমার কাছে বসে অনেক গল্প করে গেলো। আমার ভাই মারা গেছে এখনো ভাবতে পারছি না। শুধু পরিবারের সদস্যরাই নয়, গ্রামের মানুষও রুবেলের নানা স্মৃতিচারণ করে আফসোস করছে। রুবেলের মরদেহের অপেক্ষায় আছেন স্বজনরা। নিহতের স্বজনরা জানান, ২২ বছর আগে গার্মেন্টেসে চাকরির জন্য গ্রাম থেকে ঢাকায় চলে যান রুবেল। সেখানে দীর্ঘদিন চাকরির পর বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা শুরু করেন। গেলো ১০/১২ দিন আগেও তিনি গ্রামে এসেছিলেন। কথা ছিলো ছেলের বিয়ের পর আনুষ্ঠানিকতা শেষে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসবেন। কিন্তু সেটা হলো না।
প্রসঙ্গত, গত সোমবার বিকেলে ক্রেন দিয়ে বিআরটি প্রকল্পের একটি গার্ডার তোলার সময় সেটি নিচে পড়ে যায়। গার্ডারটি চলমান একটি প্রাইভেটকার ওপর পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেটি চ্যাপ্টা হয়ে যায়। গাড়িটিতে সাতজন ছিলেন। এরমধ্যে পাঁচজন ঘটনাস্থলেই মারা যান। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান হৃদয় ও রিয়া দম্পতি। নিহতরা হলেন, হৃদয়ের বাবা রুবেল, হৃদয়ের শাশুড়ি ফাহিমা খাতুন (৪০), ফাহিমার বোন ঝরণা আক্তার (২৮) এবং ঝরণার দুই সন্তান জান্নাত (৬) ও জাকারিয়া (২)। হৃদয়-রিয়া মনির বউভাতের অনুষ্ঠান শেষ করে ফিরছিলেন সবাই।