আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকার দাম না বাড়িয়ে ভর্তুকি কমাতে কৃচ্ছ্রসাধনের পথ বেছে নিয়েছে। এর মধ্যে আছে এলাকাভিত্তিক বিদ্যুতের লোডশেডিং, রাত আটটার পর দোকানপাট-শপিংমল বন্ধ, সরকারি অফিসে বিদ্যুতের ব্যবহার ২৫ শতাংশ কমানো, অধিকাংশ বৈঠক অনলাইনে করা, অত্যাবশ্যক না হলে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ পরিহার এবং শিক্ষার্থী পরিবহনে ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যবহার যৌক্তিকীকরণ। এর মধ্যে এমন পদক্ষেপও আছে, যা কেবল সংকটকালে নয়, সব সময়ের জন্যই জরুরি। যেমন সরকারি অফিসে বিদ্যুতের ব্যবহার কমানো, যথাসম্ভব অনলাইনে বৈঠক এবং অতি জরুরি না হলে কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়া বন্ধ করা। সরকার যখন অপ্রয়োজনীয় বিদেশ যাওয়ার ওপর বিধিনিষেধ জারি করেছে, তখনো কোনো কোনো সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের একশ্রেণির কর্মকর্তা নানা অসিলায় বিদেশে যাচ্ছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। করোনা কিংবা জ্বালানি সংকটকালেও তাদের ভ্রমণবিলাসিতা রহিত করা যায়নি। অন্যদিকে কোনো কোনো সরকারি অফিসে বাহুল্য বিদ্যুৎ ও গাড়িতে জ্বালানি ব্যবহারের অভিযোগ আছে। সরকার এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং করার কথা বলেছে। কমবেশি লোডশেডিং আগে থেকেই চলে আসছিল। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকার উদাহরণও আছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়, বুধবার চাহিদার পূর্বাভাস ছিল ১৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ৫১ মেগাওয়াট। সে ক্ষেত্রে ঘাটতি দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৯ মেগাওয়াট। শহর ও গ্রামাঞ্চলে সুষম সরবরাহ থাকলে দিনে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হয়। শহরাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ কম থাকায় গ্রামাঞ্চলে চাপটা আরও বাড়বে।
সরকার সরকারি অফিসে ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের ঘোষণা করেছে, কিন্তু সেটি কীভাবে হবে, তার রূপরেখা জানানো হয়নি। ৩৫টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একমাত্র পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে একটা নির্দেশনা পাওয়া গেছে, যাতে পানি ভবনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখা, ব্যক্তিগত কাজে অফিসের গাড়ি ব্যবহার থেকে বিরত থাকা, সকাল নয়টায় অফিসের কার্যক্রম শুরু করে বিকেল পাঁচটার মধ্যেই অফিস ত্যাগ করার কথা বলা হয়েছে। অন্যান্য মন্ত্রণালয় এখনো কিছু বলছে না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের জ্বালানি সাশ্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও জ্বালানি সাশ্রয় করে দেখাতে হবে। জনগণকে গণপরিবহনে চলার পরামর্শ দেওয়ার আগে তাদের উচিত হবে নিজেরা তা করে দেখানো। ‘আপনি আচরি ধর্ম’ দিয়েই এ ধরনের কর্মসূচিতে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হয়। জনগণ যখন দেখবে সরকারের নীতিনির্ধারক ও কর্মকর্তারা জ্বালানি ব্যবহারে কৃচ্ছ্রসাধন করছেন, তারাও উৎসাহিত হবেন।
তবে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে, জ্বালানি সাশ্রয় করতে গিয়ে যাতে শিল্পকারখানায় উৎপাদন কমে না যায়। বিশেষ করে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে হবে। কৃষির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
এসব পদক্ষেপের পাশাপাশি নীতিনির্ধারকেরা অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেবেন আশা করি। তাদের স্বীকার করতে হবে যে পরনির্ভর জ্বালানি নীতির কারণেই এ সংকট ঘনীভূত হয়েছে। ফলে লোডশেডিং বা কৃচ্ছ্রসাধন সাময়িক সুবিধা দিতে পারে। স্থায়ী বা টেকসই সমাধান পেতে হলে আমাদের স্থল ও জলভাগে থাকা গ্যাসসম্পদের যথাসাধ্য অনুসন্ধান ও আহরণের বিকল্প নেই।