স্টাফ রিপোর্টার: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে ৩০০ আসনেই ইভিএম ব্যবহার করা হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কোনো আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি জানান, ইভিএমে ভোটগ্রহণ আওয়ামী লীগ সমর্থন করে এবং তারা এ মেশিনে ভোট হোক তা চান। মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের ইভিএম যাচাই অনুষ্ঠান শেষে ওবায়দুল কাদের এসব কথা বলেন।
এর আগে ওই অনুষ্ঠানের সভাপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমরা ইভিএমের অন্ধ গ্রাহক ছিলাম না। সব আলোচনা লিপিবদ্ধ করেছি। আমাদের সামর্থ্য কতটুকু, তা দেখে সিদ্ধান্ত নেব। নির্বাচনে সম্পূর্ণ বা ফিফটি ফিফটি আসনে ইভিএম ব্যবহার করব কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেব। আগস্ট থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করব, তখন সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে আমরা সরকারের কাছে সহায়তা নেব, আওয়ামী লীগের কাছ থেকে নয়।
ইভিএম-এর কারিগরি দিক দেখাতে ১৯, ২১ ও ২৮ জুন তিন দিনে ৩৯টি দলকে আমন্ত্রণ জানায় ইসি। তাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছে ২৮টি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে বেশির ভাগ দলই জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দেয়। মঙ্গলবার শেষ দিনে আওয়ামী লীগসহ ১৪টি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও অংশ নেয় ১০টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগসহ ৭টি দল ইভিএমে ভোটগ্রহণের পক্ষে মত দেয়। বাকি ৩টি রাজনৈতিক দল বিপক্ষে মত দিয়েছে। চারটি দল অংশ নেয়নি। সেগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ। সিইসির সভাপতিত্বে ইভিএম প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান, মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে সাত সদস্যের দল অংশ নেয়। বাকি নয়টি রাজনৈতিক দলের একাধিক সদস্য অংশ নেন।
প্রদর্শনী শেষে ওবায়দুল কাদের বলেন, আমার মনে হয় অনুষ্ঠানে অধিকাংশই ইভিএমের পক্ষে বলেছেন। ইভিএম নিয়ে বিরুদ্ধেও বলেছেন দুয়েকজন। এটা তো গণতন্ত্র। বিউটি অব ডেমোক্রেসি। বিরুদ্ধে তো বলবেনই। ভিন্নমত থাকতেই পারে। সেটা তো কোনো অসুবিধা নেই। তিনি বলেন, মন থেকে চাই, চেতনা থেকে চাই ইভিএমে ভোট হোক। ৩০০ আসনে ইভিএম হলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমরা সাপোর্ট করি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস, বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসবে। আমরাও চাই বিএনপি আসুক। আমরাও চাই একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হোক। এ কারণে বিএনপির মতো একটা বড় দল বাইরে থাকবে, এটা আমরা চাই না। আমরা চাই তারা আসুক। তিনি বলেন, দল হিসাবে আমরা বলেই যাচ্ছি বিএনপি নির্বাচনে আসুক। আমরা পদ্মা সেতুতেও দাওয়াত দিয়েছি। আমাদের পজিটিভ অ্যাটিচিউড আছে। এ কারণে আমরা তাই করি। তারা (বিএনপি) নিজেরাই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেবে, হয়তো শেষ বেলায়। ঘোলা করে খাবে আর কী।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি অবাক হয়ে শুনি ফখরুল সাহেব বলেন-এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না। ইলেকশন তো এই সরকারের অধীনে হবে না, ইলেকশন হবে ইলেকশন কমিশনের অধীনে। নির্বাচনে সহযোগিতা, ফ্যাসিলিটিজ দরকার, সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস আমরা আগেও দিয়েছি, এখনো আমরা নির্বাচন কমিশনকে আশ্বাস দিয়েছি। আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করব। নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে তিনি বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনকালীন সরকার গঠন হয়, বাংলাদেশেও শেখ হাসিনার সরকার সেটাই অনুসরণ করবে। এর আগে ইভিএম প্রদর্শনীতে ওবায়দুল কাদের বলেন, আগামী নির্বাচনে ইভিএমের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করার জন্য আমরা সিইসির কাছে আহ্বান জানিয়েছি। আমরা মনে করি, দেশে ইভিএম পদ্ধতি অধিকতর জনপ্রিয় এবং সহজে ব্যবহার করার লক্ষ্যে ইসি এখন থেকেই প্রচার-প্রচারণায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে।
এদিকে সভাপতির বক্তব্যে সিইসি বলেন, ইভিএমে ইন্টারনেটের কোনো সম্পর্ক নেই বিধায় হ্যাকিংয়ের কোনো আশঙ্কা নেই। আমি নিজেও কিন্তু গুজবে বিশ্বাসী। গুজব শুনতে খুব ভালা লেগেছে। আমার জীবনও ওভাবে কেটেছে। এখন যখন আমাকে নিয়ে কথা শুনি, সেগুলো কিন্তু সত্য না। অথচ আমি আগে এভাবেই গুজবই বিশ্বাস করতাম। আসলে মানুষের স্বভাবটাই হচ্ছে গুজবটা খুব শুনতে ভালো লাগে। নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে সিইসি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, সেই সময় সরকার থাকবে; কিন্তু আওয়ামী লীগ থাকবে না। সরকার আর আওয়ামী লীগ এক না। আমরা সরকারের কাছে হেল্প নেব। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আমরা কোনো হেল্প নেব না, প্রশ্নই আসে না। কাজেই আমরা বিশ্বাস করি, সরকার ও আওয়ামী লীগের মধ্যে যে বিভাজনটা আছে, সেই বিভাজনটাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে? উচ্চারণ করতে শুনেছি। উনি এ ব্যাপারে খুবই স্পষ্ট, সরকারের তরফ থেকে আমাদের সহায়তা দেয়া হবে। তিনি বলেন, আমরা সেই সহায়তা পাওয়ার অধিকারী। সেই সহায়তা আমরা আদায় করে নেব। যেই সহায়তা আমরা প্রাপ্য, সেই সহায়তা আমাদের দিতে হবে। সেই সহায়তা যদি দেয়া না হয়, আপনারা যদি আশাই করেন যে সুন্দর ইলেকশন হবে, সুন্দর ইলেকশন হয়তো হবে না। আরেকটা জিনিস হলো-আমরা আপনাদের মাঝে ঐক্য চাচ্ছি, নির্বাচন মাঠে সবাই থাকবেন এবং বিভিন্ন পার্টির উপস্থিতিতে নির্বাচনের মাঠে এক ধরনের ভারসাম্য সৃষ্টি করে।
ওবায়দুল কাদেরের উদ্দেশে সিইসি বলেন, আপনারা সরকারে থেকে আমাদের সরকারি সাহায্য-সহায়তা দেবেন। আমরাও যে সহায়তা চাইব, তাও সানুগ্রহে প্রদান করবেন। যাক, আপনি বলেছেন (ওয়াবদুল কাদের হ্যাঁ বলেন) এজন্য আমরা আশ্বস্তবোধ করছি। এই আশ্বাসটা নিয়ে আমরা আগামী দিনে কাজ করে যাব।
অন্যান্য রাজনৈতিক দল: অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক (এমএল) দিলীপ বড়ুয়া আওয়ামী লীগের প্রস্তাবে একাত্মতা পোষণ করেন। ১৪ দল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিশ্বাস করে। গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, তিনশ আসনে ইভিএম ব্যবহার করুন। এজন্য ইভিএমের স্বল্পতা কীভাবে মেটানো যায়, সেই ব্যবস্থা নিন। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য মোশাররফ হোসেন বলেন, ইভিএম পরিচিত করানো নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এই মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ভোট করা ঠিক হবে না। স্থানীয় নির্বাচনসহ পেশাজীবীদের ভোটে আইনের বাইরে গিয়ে ইভিএম পরিচিত করার মত দেন। আগামী নির্বাচনগুলোকে ইভিএমের মাধ্যমে করার মত দেন তিনি। এজন্য নির্বাচন কমিশনকে এখন থেকেই ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন। বিকল্প ধারার মহাসচিব আব্দুল মান্নান বলেন, আমরা অবশ্যই ইভিএম চাই। তবে প্রশ্ন হলো-এই প্রযুক্তিতে ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন কি না? সব বুথে ইভিএম ব্যবহারের সক্ষমতা আছে কি না? ইভিএম উন্নত প্রযুক্তি বলে মনে করেন ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি বলেন, ইভিএম ব্যবহারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে ইভিএম ব্যবহারের আগে স্থানীয় নির্বাচনে ভোট করলে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব রেজাউল হক চাঁদপুরী বলেন, সবাই যেহেতু ইভিএম বিষয়ে একমত না, এজন্য কমপক্ষে ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করা যেতে পারে।
তবে ইভিএম-এর বিপক্ষে মত দিয়ে গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য সুরাইয়া বেগম জানান, তাদের দল ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট চায় না। বর্তমান কমিশনকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ইভিএমের মাধ্যমে খুব সহজেই জালিয়াতি করার অনেক ম্যাকানিজম রয়েছে। ই-ভোটিং পদ্ধতিতে প্রোগ্রামিং পরিবর্তন করে জালিয়াতি করার সুযোগ থেকেই যায়।’ ইভিএম-এর মাধ্যমে ভোটাধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাই না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতি সম্মান দেখিয়ে হলেও সংসদ নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতি থেকে সরে আসা উচিত।’
বাংলাদেশ আওয়ামী-ন্যাপের মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূইয়া মনে করেন, ইভিএম-এর পুরো পদ্ধতিটাই আস্থাহীনতা। তিনি বলেন, ‘ইভিএমে জনগণের কোনো আস্থা নেই? ইভিএম সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভোট চুরির যন্ত্র।’ অনেক দেশ ইভিএম থেকে সরে এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা ঠিক হবে না।’ আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে সরকার ও নির্বাচন কমিশন আগ্রহী বলে মনে করেন সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের সভাপ্রধান আবু লায়েন্স মুন্না। তিনি বলেন, ‘ইভিএম থেকে ইসির সরে আশা উচিত। দেশের আশি শতাংশ ভোটার গ্রামে বাস করে। তাদের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে।