ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: রাজা আর যাদব দুটি কবুতরের নাম। তাদের জন্ম যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে। ওই কারাগারে ছিলেন যাবজ্জীবন দ-প্রাপ্ত আসামি মিজানুর রহমান (৪৭)। কারাবন্দী জীবনে মিজানুরের সঙ্গী ছিলো কারাগারের এক ঝাঁক কবুতর। তবে এর মধ্যে রাজা আর যাদবের সঙ্গে মিজানুরের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। মিজানুর মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তার সঙ্গে রাজা আর যাদবও এসেছে কারাগার থেকে বাড়িতে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হরিশংকরপুর ইউনিয়নের বাকড়ি গ্রামের মৃত আনোয়ার হোসেনের চার সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে মিজানুর রহমান।
সরেজমিনে তার বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, মিজানুর রহমান একটি হত্যা মামলায় আসামি ছিলেন। ১৯৯৭ সালে মামলাটির রায়ে তার যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। ১৯৯৯ সালে ২৮ জুলাই তিনি আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। ওই সময় তার বয়স ছিলো ২৫ বছর। এরপর দীর্ঘ ২২ বছর ১০ মাস পর গত ২ জুন তিনি মুক্তি পেয়েছেন। কারাজীবনে তিনি খুলনা, ঝিনাইদহ, যশোর ও ঢাকা কারাগারে থেকেছেন। সর্বশেষ তিনি মুক্তি পান যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে। এরপর থেকে দুই কবুতর নিয়ে মিজানুর নতুন জীবন শুরু করেন। মিজানুর রহমান যে ঘরে ঘুমান, সেই ঘরেই কবুতরগুলো থাকতো। তবে অপরিচিত জায়গা হওয়ার কারণে ৭ জুন যাদব উড়তে গিয়ে ঘরের ফ্যানের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এতে কবুতরটি মারা যায়। এ মৃত্যুতে মিজানুরসহ তার পরিবারের লোকজন খুব কষ্ট পেয়েছেন। সঙ্গীর মৃত্যুতে রাজাও দুই দিন কিছুই খায়নি।
রাজাবাবু এখন একাই ওই বাড়িতে থাকে। গম ছাড়া সে কিছু খায় না। প্রতিদিন তাকে গোসল করাতে হয়। একদিন পরপর শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করাতে হয়। অন্য কবুতর তাদের জন্য বানানো ঘরে থাকলেও রাজাবাবু থাকে মিজানূরের শোয়ার ঘরে। ফ্যানের বাতাস সে খুবই পছন্দ করে।
মিজানুরের ছোট ভাই রেজাউল করিম বলেন, দেশীয় প্রজাতির কবুতর রাজা। তাকে মগে করে পানি খাওয়াতে হয়। এমনকি সে নিজে নিজে খায়ওনা। তাকে মুখে তুলে খাওয়াতে হয়। বাড়িতে দেশীয় প্রজাতির আরও প্রায় ৫০টির অধিক কবুতর থাকলেও সে আলাদা থাকে। সারাদিনই সে কারো না কারো ঘাড়ে, কোলে, হাতের ওপর এমনকি মাথায় চড়ে দিন পার করে। তাকে পেয়ে আমরা সবাই খুশি। মানুষের সঙ্গে কবুতরের এমন সম্পর্ক এটাই প্রথম।
প্রতিবেশী রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা খুবই অবাক হয়েছি। এমন ঘটনা আসলেই বিরল। এর আগে কখনো দেখিনি, আবার শুনিওনি। কবুতর মিজানুরের কথা শোনে। ডাকলে কাছে চলে আসে। কবুতর রাজাবাবু কখনো তার পিঠে, কখনো মাথায়, কখনো মোটরসাইকেলের ওপর বসে থাকে। এমন সম্পর্ক বিস্ময়কর। মানুষের সঙ্গে পাখির এমন বোঝাপড়া সত্যিই ব্যতিক্রম। রাজাবাবুকে একনজর দেখার জন্য মিজানুরের বাড়িতে লোকজন ভিড় করছে।
মিজানুরের ভাইয়ের মেয়ে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানিয়া সুলতানা বলে, আমি যখন বাড়িতে থাকি তখন রাজাবাবু সবসময় আমার কাছেই থাকে। ওকে কোলে করে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াই। আমাদের বাড়িতে আরও অনেক কবুতর আছে, কিন্তু সেগুলো আমার কাছে আসেও না আবার ডাকলেও শোনে না। রাজাবাবু আমার কাছে যখন থাকে, তখন আমার খুব ভালো লাগে।
মিজানুর রহমান বলেন, দীর্ঘ সময় যখন যশোর কারাগারে ছিলাম, তখন ভীষণ একাকীত্ব জীবন কাটাতাম। তখন কারাগারের কবুতরগুলোর সঙ্গে সময় কাটাতে শুরু করি। নিজে কম খেয়ে কবুতরগুলোকে খাওয়াই। কারাগারেই নতুন করে একটি দেশি কবুতরের একজোড়া ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে। তাদের নাম রাখি রাজা আর যাদব। সেই ছোট থেকেই আমি ওদের খাওয়াতাম। কবুতরগুলোও সারাক্ষণ আমার আশপাশে ঘুরে বেড়াত। একপর্যায়ে কবুতর দুটি কাঁধে উঠতে শুরু করে। আমি যেখানে ঘুমাতাম সেই বালিসের কোলে গিয়ে ওরা ঘুমাত। নামাজ পড়তে গেলেও আমার সঙ্গে নামাজের পাটিতে বসে থাকতো। এভাবেই ওদের সঙ্গে আমার ভালোবাসা তৈরি হয়ে যায়।
তিনি বলেন, কারাগারের সব কবুতরের প্রতি মায়া থাকলেও, রাজা আর যাদব নামের কবুতরের প্রতি আলাদা মায়া ছিল আমার। ২ জুন মুক্তির দিন ধার্য হয়। তার আগে থেকেই ওই দুই কবুতরের জন্য চিন্তা শুরু হয়। জেলে দুই কবুতরকে কার কাছে রেখে যাব ভাবছিলাম। তখন কোনো উপায় না পেয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলি। অবশেষে ২ জুন সন্ধ্যা ৬টায় যখন কারাগার থেকে বের হলাম, তখন রাজা আর যাদবও আমার সঙ্গে চলে এল।
মিজানুর রহমান বলেন, রাজার একটি সঙ্গী ছিলো। তার নাম রাণী। যাদব মারা যাওয়ার কয়েক দিন পর রাণীও আবার যশোর কারাগারে ফিরে যায়। তখন কারাগার থেকে ফোনে আমাকে জানায় রাণী ওখানে চলে গেছে। সব থেকে বড় কথা হলো আগে কারাগারে আমার যে কষ্ট হয়েছিলো। সেই সব কষ্ট পরিবার ও রাজাবাবুকে পেয়ে ভুলে গেছি। এখন আমি আল্লাহর রহমতে অনেক সুখেই আছি।