‘দোকান না ভেঙে আমাদের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিন’
মেহেরপুরে উচ্ছেদকালে মানববন্ধন : প্রশাসনের সংবাদ সম্মেলন
মেহেরপুর অফিস: একদিকে চলছিল বুলডোজার অন্যদিকে কান্নায় বুক চাপড়াচ্ছিলেন কয়েকজন নারী-পুরুষ। বুলডোজার যেন তাদের বুকের ওপর দিয়েই যাচ্ছে। তাদের আকুতি দোকান না ভেঙে আমাদেরকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিন। পেট্রোল দিয়ে দোকানি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের পুড়িয়ে দিতে ম্যাজিস্ট্রেটকে অনুরোধ করেন ভুক্তভোগীরা।
মেহেরপুর কোর্ট মসজিদের দোকান উচ্ছেদ চলছে। এর প্রতিবাদে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীরা সড়ক অবরোধ করেছে। তাতেও মেলেনি কোন সমাধান। অনড় অবস্থানে থাকা প্রশাসন পুলিশের সহায়তায় দোকানগুলো ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরের দিকে মেহেরপুর সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবু সাঈদের নেতৃত্বে প্রশাসনের একটি টিম কোর্ট মসজিদের সামনের দোকানপাট ভাঙা শুরু করেন। এ সময় দোকান মালিক ও তাদের পরিবারের লোকজন অনুরোধ করে সময় প্রার্থনা করেন। কিন্তু জেলা প্রশাসকের নির্দেশের কথা বলে ভাঙা শুরু করেন প্রশাসন। শত অনুরোধে যখন প্রশাসনের মন গলেনি। তখন গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেয়ার চেষ্টা করেন কয়েকজন দোকানি ও তাদের পরিবারের সদস্যারা। এ সময় অভিযানে থাকা পুলিশ সদস্যরা তাদেরকে আগুন দেয়া থেকে নিবৃত্ত করেন। তবে বুলডোজার চলতে থাকায় ব্যবসায়ীরা সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। এক পর্যায়ে সেই বিক্ষোভও নিবৃত্ত করে পুলিশ।
জানা গেছে, মেহেরপুর কোর্ট এলাকায় রাইপুর রোড়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অদূরে কোর্ট জামে মসজিদ। মসজিদের জায়গায় তৈরি করা ১৮টি দোকান। মসজিদ কমিটির কাছ থেকে ওই দোকান লিজ নিয়ে ব্যবসা করছেন অনেকে। দরিদ্র পরিবারের এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উর্পাজনের একমাত্র পথ হচ্ছে এই দোকানগুলো।
মেহেরপুর হোটেল বাজার কমিটির সভাপতি আব্দুল হান্নান জানান, কোর্ট মসজিদের সভাপতি হিসেবে পদাধিকার বলে দায়িত্বে থাকেছেন জেলা প্রশাসক। সামসুর রহমান যখন জেলা প্রশাসক ছিলেন তখন মসজিদ কমিটির কাছ থেকে দোকানগুলো লিজ নেওয়া হয়। প্রতি মাসে নির্ধারিত ভাড়া মসজিদ কমিটিতে পরিশোধ করেন দোকানিরা। সামসুর রহমানের পরে আরও তিনজন জেলা প্রশাসকের সময়ে একইভাবে লিজ নবায়ন করা হয়েছে।
জানা গেছে, মেহেরপুর জেলা প্রশাসক ড. মুহাম্মদ মুনসুর আলম খান সম্প্রতি এই দোকানগুলো অবৈধ বলে উচ্ছেদের জন্য নোটিশ দেন দোকানিদের। দোকানগুলো উচ্ছেদ করলে দরিদ্র ব্যবসায়ীরা পথে বসবে তাই দোকাান ও ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা জেলা প্রশাসককে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে অনুরোধ করে আসছিলেন।
হোটেল বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহিদ ইকবাল সিমন বলেন, একটি মাত্র নোটিশ দিয়ে মালামাল সরিয়ে নিতে বলা হয়। এইদিনে ভাঙা হবে এমন কোন সতকর্তা জারি করা হয়নি। জেলা প্রশাসকের সাথে ব্যবসায়ী সমিতির দেনদরবার চলছিলো উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই দোকানগুলো বৈধভাবে লিজ নেয়া হয়েছে। ভাঙতে যদি হয় তাহলে সময় দিলে দোকানিরাই ভেঙে নিতো। এভাবে অন্যায়ভাবে দোকান ভেঙে ব্যবসায়ীদের পথে বসানো হয়েছে।
এ কারণে হোটেল বাজার ব্যবসায়ী সমিতির অধীনে সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সুষ্ঠু সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে ঘোষণা দেন তিনি।
তবে কেন দোকান ভাঙ্গা হচ্ছে এবং কিভাবে ভাঙা হচ্ছে, আজকে দোকান ভাঙার চূড়ান্ত নোটিশ দেয়া হয়েছিল কিনা এমন সব প্রশ্ন এড়িয়ে জেলা প্রশাসকের সাথে যোগাযোগ করতে সাংবাদিকদের বলেন উচ্ছেদে নেতৃত্বে দেয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবু সাঈদ।
সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক ড. মুহাম্মদ মুনসুর আলম খানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে এড়িয়ে যান।
এদিকে মেহেরপুর কোর্ট মসজিদের সামনে দোকানপাট ভাঙা এবং হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে মেহেরপুর শহরের হোটেল বাজারের ব্যবসায়ীরা। বিকেলে মেহেরপুর মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের সামনে মেহেরপুর শহরের হোটেল বাজার ব্যবসায়ী সমিতির উদ্যোগে ওই মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। হোটেল বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুল হান্নানের সভাপতিত্বে মানববন্ধন চলাকালে সেখানে বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক জাহিদ ইকবাল শিমুন, সহ-সভাপতি মোমিনুল ইসলাম, সদস্য ইয়ারুল ইসলাম প্রমুখ।
এদিকে মেহেরপুর মডেল মসজিদের সম্মুখভাগে স্থাপনা ও দোকানপাট অপসারণ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রেস ব্রিফিং করেছেন জেলা প্রশাসক ড. মুহাম্মদ মুনসুর আলম খান। এদিন সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এ প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়। প্রেস ব্রিফিংয়ে জেলা প্রশাসক ড. মুহাম্মদ মুনসুর আলম খান লিখিত বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, মেহেরপুর জেলার সদর উপজেলাধীন বামনপাড়া মৌজা আরএস ২১৬৫নং খতিয়ানে মেহেরপুর কোর্ট মসজিদের পক্ষে সেক্রেটারি নামে ২৫২৪ দাগের ০.৫৮১৩ একর জমি মসজিদের শ্রেণীভূক্ত। উপযুক্ত জমিতে ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী মেহেরপুর কোর্ট জামে মসজিদ। সময়ের পরিক্রমায় মসজিদের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়া এবং সম্মুখভাগে বর্তমানে মসজিদের পার্শ্ববর্তী ১নং খাস খতিয়ান ভুক্ত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ডেপুটি কমিশনার মেহেরপুরের অধীনের ২৫২৪ দাগের ০.৮৩০৬ একর কোর্ট মসজিদ শ্রেণীভূক্ত জমিতে অনানুষ্ঠানিক আলোচনার ভিত্তিতে বেশ কয়েক বছর আগে মসজিদের উন্নয়নের স্বার্থে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা ও দোকানপাট গড়ে ওঠে। উক্ত দোকানপাট অত্র এলাকার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোকের জীবন-জীবিকার সংস্থানসহ মেহেরপুর জেলার ব্যবসা-বাণিজ্য তথা দেশের জিডিপিতে রেখেছে উল্লেখযোগ্য অবদান। সম্মানিত দোকানদার/ব্যবসায়ীগন মসজিদ কমিটিকেও সময় সময় অর্থসংস্থান করে মসজিদের উন্নয়ন সাধনের অবদান রেখেছেন।
জেলা প্রশাসক বলেন, ঐতিহ্যবাহী মসজিদ গুরুত্ব অনুধাবন করে ২০১৮ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় বর্তমান মসজিদের পার্শ্ববর্তী ১ নম্বর খাস খতিয়ান ভুক্ত জমিতে দৃষ্টিনন্দন মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে নির্মাণাধীন মডেল মসজিদের প্রায় ৯০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং সার্বিক প্রস্তুতি শেষে খুব শীঘ্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক শুভ উদ্বোধন করার জন্য নির্ধারিত আছে।
আনুষ্ঠানিক বরাদ্দ ছাড়াই শুধুমাত্র অনআনুষ্ঠানিক আলোচনার ভিত্তিতে সরকারের ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত জমিতে গড়ে ওঠা স্থাপনা অপসারণের লক্ষ্যে এবং নির্মাণাধীন মডেল মসজিদের পারিপার্শ্বিক ভাবগাম্ভীর্য পবিত্রতা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিতে প্রকল্পের আওতায় সীমানা প্রাচীর নির্মাণের বাধ্যবাধকতা থাকার প্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার জমিতে অস্থায়ীভাবে গড়ে ওঠা দোকানপাট ও স্থাপনাসমূহ অপারেশন করা অত্যাবশ্যক দেখা দিয়েছে। সে লক্ষে দ্যা গভর্মেন্ট এন্ড লোকাল অথরিটি ল্যান্ড এন্ড বিল্ডিংস (রিকভারি অফ পজিশন) অর্ডিন্যান্স ১৯৭০ এর বিধান মতে গত ২০/২৯/২০২২ তারিখের সম্মানিত দোকানদার ব্যবসায়ীগণকে নোটিশ করা হয়েছে। তাছাড়া সম্মানিত দোকানদার ব্যবসায়ীগণকে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিকভাবেও অবহিত করা হয়েছে। পরবর্তীতে ১৮/৫/২০২২ উচ্ছেদ কার্যক্রম গ্রহণ করলে সম্মানিত দোকানদারও ব্যবসায়ীগন সময় নেয়। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজ উদ্যোগে কোন দোকান স্থাপনা অপসারন করেননি।
তাছাড়া, উচ্ছেদ পরবর্তী সময়ে সম্মানিত দোকানদার ব্যবসায়ীগণকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে মসজিদের মালিকানায় অন্যস্থানে অথবা জেলা পরিষদের পার্শ্ববর্তী জায়গায় দোকানপাট স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে জেলা পরিষদের সম্মানিত প্রশাসক এবং ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সাথে একাধিকবার আলোচনা করা হয়েছে। যেহেতু খাস জমিতে গড়ে ওঠে স্থাপনা উচ্ছেদের বাধ্যবাধকতা রয়েছে সেহেতু এদিন (০৭/০৬/২০২৩) আনুষ্ঠানিকভাবে দোকানপাট উচ্ছেদ করা হয়। তিনি বলেন যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কাজটি সম্পন্ন করা হয়েছে। ব্রিফিংয়ে অন্যদের মধ্যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নাজমুল হুদা, লিংকন বিশ্বাস, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আশরাফুজ্জামান ভূঁইয়া সহ স্থানীয় সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।