স্টাফ রিপোর্টার: নিজের দেশে ফিরতে চাইলেন পশ্চিমবঙ্গে গ্রেফতার হওয়া এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পলাতক প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার)। নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো অস্বীকার করে পি কে হালদার বলেছেন, দেশে ফিরে যেতে চাই। গতকাল সকালে পি কে হালদারসহ ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরের (ইডি) হাতে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে মেডিকেল চেকআপের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সকালে ইডির আঞ্চলিক দফতর সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্স থেকে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। হাসপাতাল থেকে ফের সিজিও কমপ্লেক্সে নিয়ে আসা হয়। এ সময় গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কথা বলেন পি কে হালদার।
অবশ্য গত বছরই অজ্ঞাত স্থান থেকে এক ভিডিও বার্তায় পি কে হালদার বলেছিলেন, ‘আমি দেশে ফিরতে চাই। তবে বাংলাদেশ সরকারকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, সে দেশে তাকে গ্রেফতার করা হবে না।’ তবে গতকাল দেশে ফেরার ব্যাপারে তিনি কোনো শর্ত রাখেননি।
অন্যদিকে, গতকাল পি কে হালদারসহ অভিযুক্তদের দিনভর দফায় দফায় জিজ্ঞাসা করেন তদন্ত কর্মকর্তারা। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর দেন। তবে প্রথম দুইদিনের মতো বিমর্ষ ছিলেন না পি কে হালদার। বরং অপেক্ষাকৃত খোশমেজাজে দেখা গেল তাকে। ইতিমধ্যেই তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব মোবাইলের লক খুলে তদন্ত করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। প্রত্যেকের কাছ থেকেই মোবাইলে রাখা তথ্য/ডেটা সংগ্রহ করেন তারা।
সূত্রের খবর, পি কে হালদারসহ গ্রেফতারকৃতদের কাছে থাকা মোবাইল ডিভাইস থেকে মিলেছে বহু চাঞ্চল্যকর তথ্য। যার সূত্র ধরে ভারতে বিনিয়োগ করা ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ শুরু করেছে ইডি। ভারতে নানা স্থানে সম্পত্তি, ব্যবসা আর ব্যাংকে রুপি রাখার ক্ষেত্রে যারা জড়িত তাদের ওপর নজরদারি শুরু করেছে ইডি। সূত্রের খবর, ছোট ছোট একাধিক টিমে ভাগ হয়ে পি কে হালদারের গ্যাং ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদেরও এবার নিজেদের আয়ত্তে আনতে সক্ষম হবে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো। সূত্রের খবর, পি কে হালদারের হাওলা তদন্তে পাওয়া সব তথ্য অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থাকেও দেয়া হয়েছে তদন্তের রূপরেখা তৈরির জন্য। এ কাজে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার জন্য পৃথক ইউনিট তৈরি করেছে।
গত শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের ১১টি জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে মোট ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়। ২০০২ সালের ‘প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট’ (পিএমএলএ)-এর অধীন গ্রেফতার হওয়া পি কে হালদার ছাড়াও অন্য নাগরিকরা হলেন প্রাণেশ কুমার হালদার, স্বপন মিত্র ওরফে স্বপন মিস্ত্রি, উত্তম মৈত্র ওরফে উত্তম মিস্ত্রি, ইমাম হোসেন ওরফে ইমন হালদার এবং আমানা সুলতানা ওরফে শারমিন হালদার। গ্রেফতারকৃত ছয়জনকেই শনিবার কলকাতার ব্যাংকশাল আদালতে (স্পেশাল সিবিআই-১) তোলা হলে পাঁচজনকে ইডির রিমান্ডে নেয়া হয়, একজনকে জেল হেফাজতে পাঠানো হয়। আজ অভিযুক্ত সবাইকে ফের আদালতে তোলা হবে। এদিন সকালে প্রথমে সিজিও কমপ্লেক্স থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হবে বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে। সেখানে মেডিকেল চেকআপ করিয়ে তোলা হবে আদালতে। সেক্ষেত্রে ফের নিজেদের হেফাজতে চাইতে আদালতে আবেদন জানাতে পারে ইডি। কারণ ইডি সূত্রে খবর, এখনো বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর তাদের অজানা।
আদালত সূত্রে খবর, পি কে হালদারের বিরুদ্ধে কেবল একটি আইনে মামলা করা হয়েছে। সেটি হলো ‘প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট-২০০২’। অর্থ পাচার সম্পর্কিত এই আইনের ৩ ও ৪ ধারায় মামলা করা হয়েছে গ্রেফতারকৃত ছয়জনের বিরুদ্ধে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে। এবং সেই টাকা বাংলাদেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এবং এ বিষয়টি পিএমএল আইনে একটি গুরুতর অপরাধ বলে বিবেচিত করা হয়েছে। পি কে হালদার নিজের আসল নাম বদল করে শিবশংকর হালদার নামে ভারতে বসবাস করছিলেন। পি কে এবং তার সহযোগীরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে ইস্যু করা রেশন কার্ড এবং ভারত সরকারের ইস্যু করা আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড বানিয়ে ফেলেন। প্রাথমিক তদন্তে ইডি জানতে পেরেছে, বাংলাদেশ এবং ভারতীয় পাসপোর্টের পাশাপাশি পি কে হালদারের আফ্রিকার দেশ গ্রেনাডার পাসপোর্ট ছিল।
এক হিসাবেই ঋণের কমিশন ২২৭ কোটি টাকা : পি কে হালদার তার সিন্ডিকেটের সদস্যদের ঋণ পাইয়ে দিয়ে ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের ধানমন্ডি শাখায় তার সেলারি হিসেবে ঋণের কমিশন হিসাবেই ২২৭ কোটি টাকা নিয়েছেন মর্মে রেকর্ডপত্র পাওয়া গেছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন দুদকের কর্মকর্তারা।
পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা কঠিন হলেও সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে- দুদক সচিব : এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) বিদেশে যে পরিমাণ টাকা পাচার করেছেন তা ফেরত আনা কঠিন হলেও সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ভারপ্রাপ্ত সচিব সাঈদ মাহবুব খান। ভারতে পি কে হালদারের গ্রেফতারের খবর পাওয়ার পর গতকাল পি কে হালদারের বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে জরুরি বৈঠকে বসেন দুদক কর্মকর্তারা। বৈঠক শেষে সাঈদ মাহবুব খান সাংবাদিকদের বলেন, পাচার করা টাকা ফেরত আনার পদ্ধতি অনেক জটিল। আমরা আশাবাদী যে, পি কে হালদারের কাছ থেকে তথ্য পেলে মানি লন্ডারিং হয়ে যেসব সম্পদ দেশের বাইরে গেছে সেগুলো ফেরত আনা সম্ভব হবে। সাঈদ মাহবুব খান বলেন, যে মামলায় চার্জশিট হয়েছে সে মামলায় পি কে হালদারের ওয়ারেন্ট অব অ্যারেস্ট ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। আমাদের দিক থেকে প্রেসার থাকবে যে, যত দ্রুত তাকে আমরা বাংলাদেশে নিয়ে আসতে পারি। কতদিনের মধ্যে ফেরত আনা যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ভারতে যেহেতু বেশ কিছু মামলা হয়েছে, হয়তো আরও মামলা হবে। একটা মামলায় রিমান্ডেও নিয়েছে। এখন আমাদের দিক থেকে প্রেসার ও চেষ্টা থাকবে যে, যত দ্রুত তাকে আমরা আমাদের দেশে নিয়ে আসতে পারি। সেখান থেকে কতদিনের মধ্যে ফেরত আনা যায় তা স্পেসেফিক বলা কঠিন। তিনি আরও বলেন, নেপথ্যে যারা আছে তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে দুদক কোনো গড়িমসি করবে না। এটুকু নিশ্চিত যে, মামলা করার মতো যদি পর্যাপ্ত তথ্য পাই মামলা করতে দুদক কোনো গড়িমসি করবে না। পি কে হালদার সংশ্লিষ্টতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের এস কে সুর ও শাহ আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে অবশ্যই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
দুদক সূত্র জানায়, পি কে হালদারের বিরুদ্ধে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। পি কে হালদার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৩৪টি মামলা করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত প্রায় আড়াই শ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিং অপরাধের দায়ে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি একটি মামলা রুজু করা হয়। মামলা তদন্তের সময় আসামি পি কে হালদারকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করা হলে তিনি বিদেশে পালিয়ে যান। তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ৩৪টি মামলার মধ্যে তিনটির তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। বাকিগুলো তদন্তাধীন। এসব মামলার তদন্তে এখন পর্যন্ত ১২ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পি কে হালদারের সহযোগী শংখ ব্যাপারী, রাশেদুল হক, অবন্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইসহ ১০ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ছাড়া ১ হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে আদালতের মাধ্যমে ৬৪ জনের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। একই ইস্যুতে ৩৩ ব্যক্তির সম্পদ বিবরণীর নোটিস জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে দুজন সময়মতো জমা না দেওয়ায় তাদের বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়।
পূর্ববর্তী পোস্ট
মেহেরপুরে পৌর ও ৪ ইউপি নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দেয়া শুরু
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ