বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলো

সম্পাদকীয়

৭ মার্চ বাঙালির জাতীয় জীবনে অবিস্মরণীয় একটি দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনেই ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে রচিত হয়েছিলো রাজনীতির এক ঐতিহাসিক মহাকাব্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এই কথাগুলো উচ্চারণ করে কার্যত স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই ঘোষণার পরিণতির কথাও তিনি আগেভাগেই চিন্তা করেছিলেন। তাই একই সঙ্গে বলে দিয়েছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ ৭ মার্চের এমন ঘোষণা শুধু বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই দেয়া সম্ভব ছিলো। একটি ভাষণ জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলো, প্রেরণা সঞ্চার করেছিলো। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণকে বিশ্বের ইতিহাসের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণের অন্যতম বলে গণ্য করে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ভাষণ নিয়ে গবেষণা চলছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয় এই ভাষণ। এই ভাষণই বাঙালি জাতিকে প্রস্তুত করেছিলো মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও তা প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের লক্ষ্যই ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাঙালিদের যে করতে হবে তাও তার দূরদৃষ্টিতে ধরা পড়েছিলো বহু আগে। ৭ মার্চের ভাষণে সেই দিকনির্দেশনাও স্পষ্ট। ভাষণে তিনি বললেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।’ পাকিস্তানি শাসকদের উদ্দেশে ভাষণে উচ্চারিত হলো সাবধানবাণী, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবা না।’ তিনি আরও বললেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশালস্নাহ।’ আর এর পরই তার সেই অমোঘ উচ্চারণ- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা হয়ে গেলো সেদিনই। সারাদেশের মানুষ পেয়ে গিয়েছিলো স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতার সঙ্গে তুলনীয়। ৭ মার্চে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ (অলিখিত এবং স্বল্প সময়ের) বিশ্বের অন্যতম সেরা ভাষণ। এটি একটি মহাকাব্যিক রাজনৈতিক ভাষণ। মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল, স্বাধীনতা আদায় ও রক্ষা এবং জনগণকে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তাসহ কূপমন্ডূকতা থেকে মুক্ত করার দিকনির্দেশনা ছিলো এই ভাষণে। সেদিন ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ এ দেশের মানুষ হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
উল্লেখ্য, ৭ মার্চকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করে গেজেট জারির নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এরপর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ দেয়া ভাষণের দিনটিকে ঐতিহাসিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। একই সঙ্গে দিবসটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস উদযাপন সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারিকৃত পরিপত্রের ‘ক’ ক্রমিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সারাদেশে ৭ মার্চ ঐতিহাসিক দিবস হিসেবে পালন করা হবে। দীর্ঘ নয় মাসের নিরন্তর মুক্তির লড়াইয়ের পর বিজয়ী হয় জাতি। তাই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের গুরুত্ব আজও অমøান। মূলত ৭ মার্চের ভাষণই ছিলো স্বাধীনতার ঘোষণা এবং একই সঙ্গে স্বাধীনতা অর্জনের নির্দেশিত পথ। বাঙালি জাতি মহান এই নেতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করেছে, উদযাপন করা হয়েছে স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী। সুতরাং যতোকাল বাংলাদেশ নামক ভূখ- থাকবে ততোকাল বেঁচে থাকবেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাশাপাশি চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবে তার দেয়া ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More