কিয়েভ ঘিরে ফেলেছে রুশ বাহিনী : ছুটছে বিমান বিধ্বংসী ট্যাংক বহর
নাগরিকদের কিয়েভ ছাড়তে বললো রাশিয়া : দ্বিতীয়বারের মতো শান্তি আলোচনায় বসবে ইউক্রেন-রাশিয়া
মাথাভাঙ্গা মনিটর: ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ রুশ সাঁজোয়া বহর। হামলার হুঁশিয়ারি দিয়ে নাগরিকদের কিয়েভ ছেড়ে যাওয়ার জন্য বলেছে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। বুধবার বেলারুশ সীমান্তে দ্বিতীয়বারের মতো শান্তি আলোচনায় বসবে ইউক্রেন-রাশিয়া। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈঠকে ভিডিও কনফারেন্সে যোগ দিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনিস্কি। স্বাগত বক্তৃতায় বলেছেন, ইউক্রেনকে কেউ ভাঙতে পারবে না। যুদ্ধাপরাধের দায়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করার কথা বলেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। ইউক্রেনে কমপক্ষে ৪শত ৬ জন সাধারণ নাগরিক নিহত হওয়ার তথ্য দিয়েছে জাতিসংঘ।
মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাক্সার টেকনোলজিস প্রকাশিত স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে, রুশ বাহিনীর সাঁজোয়া বহর এখন কিয়েভের দোরগোড়ায়। রাজধানী শহর থেকে মাত্র ২৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে দীর্ঘ বহরটি যা বড় ধরনের হামলার ইঙ্গিত দিচ্ছে। বেলারুশের সেনাবাহিনীও রুশ বাহিনীর সাথে হামলায় যোগ দেবে বলে দাবি করছে ইউক্রেন সেনাবাহিনী।
সোমবারের আলোচনায় কোনও সিদ্ধান্ত না আসলেও বেলারুশ সীমান্তে আজ বুধবার আবারও আলোচনায় বসবে দুই পক্ষ। আলোচনার আগে নাগরিকদের কিয়েভ ছেড়ে যাওয়ার জন্য সতর্ক করে দিয়েছে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে কিয়েভের প্রযুক্তি কেন্দ্রে হামলার খবর পাওয়া গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈঠকে ভিডিও কনফারেন্সে যোগ দিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনিস্কি। স্বাগত বক্তৃতায় ইউক্রেনকে কেউ ভাঙতে পারবে না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। ইইউ যে ইউক্রেনের পক্ষে তা প্রমাণ করার সময় এসেছে একথাও বলেন জেলেনস্কি। খারকিভে রুশ হামলাকে যুদ্ধাপরাধ বলে উল্লেখ করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। রুশ বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। রাশিয়ার রণকৌশলে যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ পাচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতও। দেশটিকে বিচারের মুখোমুখি করার কথা বলেছেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট-আইসিসি’র তদন্ত কর্মকর্তা।
ইউক্রেনে ৬ দিন ধরে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে রাশিয়া। তবে যে লক্ষ্য নিয়ে রাশিয়া অভিযান শুরু করেছে তা এখনও অর্জন করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী-ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে এবং দেশটির বেশিরভাগ সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করার লক্ষ্য নিয়ে রুশ সামরিক বাহিনী দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ২৩ ফেব্রুয়ারি হামলা শুরুর ৫ দিন পর সোমবার যুদ্ধ থামাতে বেলারুশের সীমান্তে আলোচনায় বসে দুদেশের প্রতিনিধিরা। তবে এ আলোচনায় কোনো সমাধান আসেনি। আলোচনা চলার সময়ও রাশিয়া হামলা অব্যাহত রাখে। আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর হামলার তীব্রতা বাড়িয়ে দেয় রুশ বাহিনী।
মঙ্গলবার কিয়েভে হামলা শুরুর হুমকি দিয়ে রাশিয়া কিয়েভবাসীদের প্রতি সতর্কতা জারি করেছে। বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। বিকালের দিকে এক বিবৃতিতে রুশ কর্মকর্তারা জানান, ইউক্রেনের নিরাপত্তা বিভাগের প্রযুক্তি কেন্দ্র এবং প্রধান সাই-অপ সেন্টার টার্গেট করে হামলা চালানো হবে। এসব সামরিক স্থাপনার কাছাকাছি এলাকা থেকে বেসামরিক লোকজনকে দ্রুত সরে যেতে অনুরোধ করা হচ্ছে। রুশ কর্মকর্তারা বলেন-রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রচারণা বন্ধের লক্ষ্যে এ হামলা চালানো হবে। এদিকে, এয়ার রেইডের সাইরেন বাজানোর পরপরই কিয়েভে রুশ বিমান বোমা বর্ষণ করে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য পরাশক্তিগুলোর আশঙ্কা-রুশ সামরিক বহর কিয়েভ দখলের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছে এবং যে কোনো সময় দখল নিয়ে নিতে পারে। পথে পথে আরও বেশি শক্তি সঞ্চয় করছে বাহিনীটি। উপগ্রহ চিত্রে রাশিয়ার প্রায় ৪০ মাইল লম্বা সাঁজোয়া বহরের ছবি ধরা পড়ে। বহরটি ধীরে ধীরে কিয়েভের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শহরের বাসিন্দাদের আশঙ্কা-রাশিয়ার সৈন্যরা ‘মধ্যযুগীয় কায়দায়’ শহর অবরোধ করতে পারে। খাদ্য, পানি ও জরুরি সরবরাহ বন্ধের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সার ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর স্যাটেলাইট চিত্র প্রকাশ করে। সোমবার সন্ধ্যার স্যাটেলাইট চিত্রে ‘দীর্ঘ ৪০ মাইল দীর্ঘ রুশ সেনাবহর’ শনাক্ত করা হয়। শত শত ট্যাংক, কামান, সাঁজোয়া যানসহ সামরিক সরঞ্জামাদির অবস্থান শনাক্ত খুবই সহজ। ইউক্রেনে বিশাল রুশ সামরিক বহর সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মকর্তারা দেশটির আইনপ্রণেতাদের সতর্ক করে বলেছেন, এ বাহিনী ইউক্রেনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে ফেলতে পারে। সাবেক রুশ উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই ফেদরোভ বলেছেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন ২ মার্চের মধ্যেই জয়ের মধ্যদিয়ে এ অভিযান শেষ করতে চান। আর মঙ্গলবার ৪০ মাইলের সাঁজোয়া বহর সেই ২ মার্চের মধ্যে যুদ্ধ শেষ করার ইঙ্গিত কিনা, সেটি হয়তো সময়ই বলবে।
কিয়েভের মেয়র ভিটালি ক্লিটসকো বলেছেন, রুশ বাহিনী কিয়েভে বিরতিহীনভাবে হামলা চালাচ্ছে। অসংখ্য গ্রুপে ভাগ হয়ে তারা এ আক্রমণ করছে। বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রুশ সেনাবাহিনীর ক্লাস্টার ও ভ্যাকিউম বোমা ব্যবহারের অভিযোগ করেন তিনি। মেয়র ও সাবেক বক্সিং তারকা ভিটালি আরও বলেন, প্রতি ঘণ্টায় আমরা বিস্ফোরণের শব্দ শুনছি। হামলার গতি ক্রমাগত বাড়ানো হচ্ছে। শহরের বাসিন্দারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অধিকাংশ সময় তারা বাংকারেই থাকছেন।
ইউক্রেনের সেনাদের ‘হিরো’ অভিহিত করে মেয়র ভিটালি বলেন, হাজার হাজার নাগরিক বেসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। জনগণ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন। তারা নিজেদের পরিবার, ঘর-বাড়ি এবং দেশের ভবিষ্যৎ রক্ষায় লড়াই করছেন। তিনি বলেন, রুশ বাহিনী আমাদের ভবিষ্যৎ চুরি করতে এসেছে। আমরা যুদ্ধ করতে ও মরতে প্রস্তুত। কারণ, এটা আমাদের বাড়ি, আমাদের দেশ, আমাদের ভবিষ্যৎ।
খারকিভে রাশিয়ার সর্বশেষ হামলার আগে জেলেনস্কি জানান, ইচ্ছাকৃত বেসামরিককে নিশানা করার প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য রয়েছে। রুশ সেনারা নির্মমভাবে বিমানের কামান থেকে গুলিবর্ষণ করেছে। সোমবার শেষ রাতে ইউক্রেনীয়দের উদ্দেশে এক ভাষণে তিনি আরও বলেন, এটি স্পষ্টভাবে একটি যুদ্ধাপরাধ। শান্তিপূর্ণ শহর। শান্তিপূর্ণ আবাসিক এলাকা। কোনো সামরিক স্থাপনা নেই। ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। রুশরা জানত তারা কাদের গুলি করছে। জেলেনস্কির দাবি-মস্কো কিয়েভের জনগণের ওপর যুদ্ধাপরাধ করছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে এর বিচার হতে হবে।
এদিকে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ বন্ধের শর্তের কথা তুলে ধরেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। সোমবার তিনি বলেন, শুধু নিরাপত্তা নিয়ে রাশিয়ার বৈধ উদ্বেগ বিবেচনায় নিলেই ইউক্রেন সংকটের সমাধান সম্ভব। আর এক্ষেত্রে ইউক্রেনের নিরপেক্ষতা ও নিরস্ত্রীকরণ এবং ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার সার্বভৌমত্বের পশ্চিমা স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে ক্রেমলিনের বিবৃতি থেকে এটিও স্পষ্ট- যেসব যুক্তি ও দাবিতে ইউক্রেনের হামলার নির্দেশ পুতিন দিয়েছিলেন তা থেকে একচুলও নড়েননি তিনি। পশ্চিমাদের কাছ থেকে নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞায় তিনি কোনো চাপ বোধ করার ইঙ্গিতও ক্রেমলিনের বিবৃতিতে পাওয়া যায়নি। তবে ক্রেমলিন বলেছে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার অবস্থানে কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না। মঙ্গলবার রুশ প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে সরাসরি আলোচনা শুরু হলেও দুদেশের প্রেসিডেন্টের বৈঠক বা আলোচনার কোনো পরিকল্পনা আপাতত নেই। বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রুশ সেনাবাহিনীর ক্লাস্টার ও ভ্যাকিউম বোমা ব্যবহারের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পেসকভ। তিনি বলেছেন, এসব অভিযোগ ভুয়া। ইউক্রেনে রুশ হামলার ষষ্ঠ দিনে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাতেও তিনি অস্বীকৃতি জানান।