জলস্থল ও আকাশপথে চালানো হচ্ছে হামলা : রাশিয়ার দখলের দ্বারপ্রান্তে ইউক্রেন
মাথাভাঙ্গা মনিটর: টানা দ্বিতীয় দিনের মতো শুক্রবারও ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভসহ বিভিন্ন বড় বড় শহরে বিমান হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। কিয়েভের কেন্দ্রস্থল থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার দূরের ওবোলোনে ঢুকে পড়েছে রুশ ট্যাংক বহর। ট্যাংক থেকেও মুহুর্মুহু গোলা ছোড়া হচ্ছে। কৃষ্ণসাগরে সক্রিয় রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও বলা হয়েছে, রুশ সেনারা কিয়েভের পার্লামেন্টের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। মার্কিন কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, ৯৬ ঘণ্টাতেই কিয়েভের পতন হবে। ইউক্রেনের খারকিভ, উত্তর ইউক্রেন ও দক্ষিণের ওডেসায়সহ বড় শহরগুলোতে রুশ সেনাদের সঙ্গে ইউক্রেনীয় সেনাদের সম্মুখ লড়াইও চলছে। ইতোমধ্যে চেরনোবিল পারমাণবিক এলাকা, একটি বিমানঘাঁটি ও স্নেক আইল্যান্ড রুশ সেনাদের দখলে চলে গেছে। তবে ‘কিয়েভের পতনের চূড়ান্ত মুহূর্তে’ আলোচনার বার্তা দিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেনের সঙ্গে তৃতীয় কোনো দেশে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত দেশটি। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এমন ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, আলোচনা করতে চাইলে বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে তা হতে পারে। এর আগে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। এদিকে পশ্চিমা দেশগুলোকে যুদ্ধে পাশে পাচ্ছেন না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞায় কি রাশিয়ার ওপর কোনো প্রভাব পড়েছে? ক্ষমতাধররা শুধু দেখছে, একাই লড়ছি আমরা। রাশিয়ার হামলায় শুক্রবার পর্যন্ত দেশটির সেনাসদস্যসহ অন্তত দুইশতাধিক নিহত ও ৩১৬ জন আহত হয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
এদিকে, ইউক্রেনে ২৮শ রুশ সেনা নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছেন দেশটির ডেপুটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হান্না মালিয়ার। এক ফেসবুক পোস্টে তিনি এই দাবি করেন। তিনি আরো জানান, ইউক্রেনের সেনাবাহিনী রাশিয়ার আশিটি ট্যাংক, ৫১৬টি সাঁজোয়া যান, ১০টি বিমান ও সাতটি হেলিকপ্টার ধংস করেছে। এ বিষয়ে রাশিয়ার পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কিয়েভের একটি বিমানঘাঁটি দখলে নেয়ার দাবি করেছে
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপান নতুন করে রাশিয়ার ব্যাংক, কোম্পানি এবং ব্যক্তিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রো জানিয়েছেন, তিনি ভøাদিমির পুতিনকে টেলিফোন করে হামলা বন্ধ করতে বলেছেন। হামলার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে পুতিন বলেছেন, রাশিয়াকে রক্ষায় আর কোনো বিকল্প ছিল না। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, দখল নয়, ইউক্রেনকে নিরস্ত্র করতে চায় রাশিয়া। যুদ্ধে জড়ানোর প্রতিবাদে রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে হাজার-হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছে। এ সময় অন্তত ১৮০০ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার ভোর থেকেই ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভসহ দেশটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। বিভিন্ন দিক থেকে ট্যাংক বহর নিয়ে রাজধানীর অভিমুখে এগোতে থাকে রুশ বাহিনী। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রথম দিন তারা সমতলে থাকা ইউক্রেনের ৮৩টি লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করেছে। দ্বিতীয় দিন চেরনোবিলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও স্নেক আইল্যান্ডসহ বিভিন্ন অঞ্চল দখলে নিয়েছে। কৃষ্ণসাগরের ছোট দ্বীপ স্নেক আইল্যান্ডকে রুশ সেনাদের কাছ থেকে সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন ১৩ ইউক্রেনীয় সেনা। রুশ যুদ্ধজাহাজের কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন তারা। পরে ওই যুদ্ধজাহাজ থেকে ছোড়া বোমার আঘাতে মৃত্যু হয় তাদের।
এ প্রসঙ্গে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভøলোদেমির জেলেনস্কি বলেন, আমাদের জিমিনি দ্বীপকে (স্নেক আইল্যান্ড) সুরক্ষিত রাখতে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন সীমান্তরক্ষীরা। বীরত্বপূর্ণভাবে জীবন বাজি রেখেছেন। তারপরও হাল ছেড়ে দেননি। তাদের সবাইকে ইউক্রেনের বীর হিসাবে মরণোত্তর স্বীকৃতি দেয়া হবে।
বাংলাদেশ সময় শুক্রবার বিকেলে এক টুইট বার্তায় ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, রুশ সেনারা কিয়েভের পার্লামেন্ট থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার উত্তরের শহর ওবোলনে ঢুকে পড়েছে। মন্ত্রণালয় রুশ সেনাদের শত্রু হিসাবে উল্লেখ করে তাদের ঠেকাতে ককটেল তৈরির জন্য কিয়েভের বাসিন্দাদের অনুরোধ জানিয়েছে। তাদের নিরাপদে থাকতেও বলা হচ্ছে। টুইটে বলা হয়, ‘বাসিন্দারা, সতর্ক হোন। বাড়ি থেকে বের হবেন না।’
ইউক্রেনের সেনাবাহিনী বলেছে, রাজধানী কিয়েভের উপকণ্ঠে দিমার ও ইভানকিভ এলাকায় রুশ সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ চলছে। ওই এলাকায় রাশিয়ার বেশ কিছু সাঁজোয়া যান ঢুকে পড়েছে। তারা আরও জানায়, রাশিয়ার সেনাবাহিনী যাতে কিয়েভের দিকে আর এগোতে না পারে সে জন্য তেতেরিভ নদীর সীমান্তবর্তী একটি সেতু ধ্বংস করে দিয়েছে ইউক্রেনের সেনারা। দ্বিতীয় দিনে রাশিয়ার আরও একটি বিমান ভূপাতিত করেছে বলেও দাবি করে তারা। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ভাদিম দেনিসেনকো বলেছেন, ২৪ ঘণ্টায় রাশিয়া ৩৩টি বেসামরিক জায়গায় হামলা চালিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অ্যান্তন হেরাসচেনকো সতর্কতা জারি করে বলেছেন, আজকের দিনটি খুবই কঠিন। রাশিয়া উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে কিয়েভে ঢোকার চেষ্টা করছে।
ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র রাশিয়ার হামলার পরিকল্পনার বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছে। তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। গোয়েন্দা সংস্থার ওই সূত্রটি বলছে, রাশিয়া কিয়েভের বিমানবন্দর দখল করতে চায়। কিয়েভের বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট করে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে রাশিয়ার। মন্ত্রিসভা, পার্লামেন্টের মতো সরকারি ভবনের নিয়ন্ত্রণও নিতে চাইবে তারা। রাশিয়া জার্মানির মতো ইউক্রেনকেও পূর্ব ও পশ্চিম দুই ভাগে ভাগ করতে চায়।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, কিয়েভের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হোসটোমেল বিমানঘাঁটি দখল করে নিয়েছে তারা। এই অভিযানে ইউক্রেনের স্পেশাল ইউনিটের ২০০ সেনা নিহত হয়েছে।
স্থানীয় সময় শুক্রবার সকালে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি বলেন, ‘আমরা একা আমাদের দেশকে রক্ষার জন্য লড়াই করছি। গতকালের (বৃহস্পতিবার) মতোই বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো দূর থেকে শুধু সবকিছু দেখে যাচ্ছে।’ তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘গতকালের নিষেধাজ্ঞায় কি রাশিয়ার ওপর কোনো প্রভাব পড়েছে? আমরা আকাশে যে শব্দ শুনছি ও যা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা যথেষ্ট নয়।’ জেলেনস্কি আরও বলেন, ‘সহিংসতা নিরসনে ও হামলা বন্ধের জন্য রাশিয়াকে আমাদের সঙ্গে কথা বলতেই হবে। সেটা এখন হোক বা পরে। যত তাড়াতাড়ি আলোচনা শুরু হবে, রাশিয়ার ক্ষতি তত কম হবে। হামলা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের দেশ রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাব।’
‘৯৬ ঘণ্টাতেই পতন হবে কিয়েভের’ : অগ্রসর হতে থাকা রুশ বাহিনীর হাতে কয়েকদিনের মধ্যেই ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের পতন হবে বলে আশঙ্কা করছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। দেশটির সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন নিউজউইককে তিন মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ৯৬ ঘণ্টাতেই কিয়েভের পতন হবে। আর তার এক সপ্তাহের মধ্যে ইউক্রেনের নতুন নেতৃত্ব ঠিক করা হবে।
১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ জাতিসংঘের : যুদ্ধের ফলে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ইউক্রেনের মানুষের সাহায্যার্থে ২০ মিলিয়ন ডলার (১৫০ কোটি টাকা) বরাদ্দ করেছেন তিনি। গুতেরেস বলেন, প্রত্যেক দেশ যে নীতি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি নিয়েছিল, এক দেশের অন্য দেশকে আক্রমণের মাধ্যমে সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হয়েছে। এটা ঠিক নয়, এটা সনদের বিরোধী, কিন্তু এটা আর ফিরিয়ে নেয়া যাবে না। জাতিসংঘ বলছে, এরই মধ্যে অন্তত এক লাখ মানুষ যুদ্ধের সহিংসতা থেকে বাঁচতে ঘর ছেড়েছে। ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী দেশ পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও মলদোভায় শরণার্থী পরিবারের সদস্যদের আশ্রয় নিতে দেখা গেছে।
আগ্রাসন বিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল রাশিয়া : ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাশিয়া। তবে প্রতিবাদীদের মুখ বন্ধ করতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে পুতিন প্রশাসন। আক্রমণ ও বিক্ষোভের প্রথমদিনই গ্রেফতার করা হয়েছে অন্তত ১ হাজার ৮০০ জনকে। সেন্ট পিটার্সবার্গ ও ইয়েকাটেরিনবার্গের রাস্তায় নেমে ক্ষোভ জানিয়েছেন শত শত মানুষ। প্রতিবেশী দেশে আক্রমণের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও। মস্কোর একটি সরকারি থিয়েটারের পরিচালক ইয়েলেনা কোভাল্লায়া ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, একজন খুনির জন্য কাজ করা ও তার থেকে অর্থ নেয়া সম্ভব নয়।
দখল নয়, ইউক্রেনকে নিরস্ত্র করা হবে-রাশিয়া : রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ইউক্রেন পুরোপুরি দখল করে নেয়ার ইচ্ছা নেই রাশিয়ার। মস্কো শুধু ইউক্রেনকে সামরিকভাবে নিরস্ত্র করতে চায়। এজন্য ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছে ক্রেমলিন। তিনি বলেন, দেশটিকে এখন নিজেদের ভাগ্য বেছে নিতে হবে। লাভরভ বলেন, ‘সাবেক যুগোসøাভিয়া, ইরাক ও লিবিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলো আগ্রাসন চালিয়েছিল। গণতন্ত্রের নামে এসব আগ্রাসনে হাজারও নিরস্ত্র মানুষের প্রাণ গেছে। পশ্চিমারা ইউক্রেনের হাতেও অস্ত্র তুলে দিয়েছে। তাই রাশিয়া দেশটিকে নিরস্ত্র করবে। অস্ত্র ত্যাগ করলে রাশিয়া আলোচনা করতেও প্রস্তুত বলে জানান তিনি।