বিশেষ পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও পাঠদান চলবে
স্টাফ রিপোর্টার: শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক স্তর বাদ রেখেই নতুন শিক্ষাক্রমের পরীক্ষামূলক (পাইলটিং) কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২২ ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ শ্রেণির নতুন পাঠ্যবই ৬২টি স্কুল ও মাদরাসায় পড়ানো শুরু হবে। এর ফলে ভেঙে যাবে ৬০ বছরের প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতি। এর স্থলে আসবে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন ও মূল্যায়ন (পরীক্ষা) প্রক্রিয়া। সবমিলে নতুন যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের লেখাপড়া।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, এবার প্রথম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে উল্লিখিত পদ্ধতির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতায় প্রথম শ্রেণি পিছিয়ে আছে। মন্ত্রণালয়টি প্রথমে আগের শিক্ষাক্রমও চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। চাপের মুখে তাতে ব্যর্থ হলে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে বই তৈরির কাজ ফেলে রাখে। এমনকি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়নি। এখন ২২ ফেব্রুয়ারির পর এ নিয়ে একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে অর্থ বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হলে প্রাথমিকেও নতুন শিক্ষাক্রম যুক্ত হবে।
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, বিগত ৬০ বছরের পুরোনো পাঠ্যপুস্তকের খোলস থেকে বের করে আনার ছাঁচে সাজানো হয়েছে এবারের শিক্ষাক্রম। করোনা মহামারির কারণে গোড়া থেকেই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন বিঘিœত হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে ২০২১ সালেই পাইলটিং শুরু করা হতো। কাজ করতে না পারায় পিছিয়ে এবারের জানুয়ারিতে শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু প্রস্তুতিতে বিঘœ ঘটে। তবে আশা করা যাচ্ছে, স্কুল খুলে দিলে ২২ ফেব্রুয়ারি সরাসরিই পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করা হবে। আর কারিগরি পরামর্শক কমিটি যদি স্কুল খোলার ব্যাপারে সায় না দেয়, তাহলে অনলাইনে হলেও পাইলটিং শুরু করা হবে। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দু-একদিনে জানানো হবে।
প্রাথমিকের শিক্ষাক্রম তৈরির কাজে নেতৃত্ব দেন এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক ড. রিয়াজুল হাসান। আলাপকালে বুধবার তিনি জানান, ‘আইসব্রেকিং’ (বরফগলা) শুরু হয়েছে। চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৪) সর্বশেষ বৈঠকে শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রথম শ্রেণির পাঠ্যবই তৈরি ও মুদ্রণ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং পাইলটিংয়ের পেছনে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, এ মাসের শেষে এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। সেটি হলে মে মাসের মাঝামাঝি পাইলটিং শুরু করা যাবে।
এদিকে সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারণে প্রথম শ্রেণির পাইলটিং সাড়ে ৪ মাস পেছানোয় এর প্রভাব সার্বিক প্রক্রিয়ার ওপরে পড়বে। এবারে পাইলটিং শুরু হলেও এর ফলাফল এনে আগামী বছরে প্রথম শ্রেণিতে চূড়ান্ত পাঠ্যবই যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। সেক্ষেত্রে আগামী বছরও ‘পরীক্ষামূলক’ পাঠ্যবই যাবে প্রথম শ্রেণিতে। ইতঃপূর্বে নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২৩ সালে প্রথম শ্রেণিতে চূড়ান্ত আর দ্বিতীয় শ্রেণিতে পরীক্ষামূলক পাঠ্যবই দেওয়ার কথা। এখন আগামী বছর দুই শ্রেণিতেই ‘পরীক্ষামূলক’ সংস্করণ যাবে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের হাতে। বিষয়টি নিশ্চিত করে অধ্যাপক হাসান বলেন, সময়স্বল্পতায় যেহেতু কার্যকর পাইলটিং হয়নি, তাই এমনটি হতে পারে।
এদিকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পাইলটিং শুরুর জন্য পুরোপুরি এনসিটিবি প্রস্তুত বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, ষষ্ঠ শ্রেণিতে মোট ১৩টি পাঠ্যবই আছে। এর মধ্যে বাংলা বাদে বাকি বইগুলো অনেকটাই অভিজ্ঞতামূলক শিখনপদ্ধতি সামনে রেখে তৈরি করা হয়েছিল। সময়স্বল্পতার কারণে গোটা বছরের পাঠ্যবই একসঙ্গে দেয়া যায়নি। ১২ মাসকে তিনভাগ করে চার মাসের পাঠ একসঙ্গে পাঠানো হবে নির্বাচিত স্কুলগুলোয়। কীভাবে পাঠদান করা হবে, এর নির্দেশনাসংবলিত শিক্ষক গাইড তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট স্কুল ও মাদরাসার শিক্ষক এবং উপজেলা শিক্ষা অফিসের একাডেমিক সুপারভাইজারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
পাঠ্যবই প্রস্তুতের পর এ নিয়ে ১২ ফেব্রুয়ারি ‘গণমাধ্যমে’ ব্রিফিং হয়। সেদিন অবশ্য গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা বিভিন্ন দিক উল্লেখ করেন। এর মধ্যে আছে-বাংলা বই পুরোপুরি অভিজ্ঞতাভিত্তিক হিসাবে রচনা না করা, পাইলটিং কাজের অপরিহার্য অংশ উপজেলা ও জেলা শিক্ষা অফিসার এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের প্রশিক্ষণ না দেওয়া। জানা যায়, এরপর প্রথম চার মাসের পাঠ্যবইয়ের পাঠদানের ব্যাপারে শিক্ষক গাইডে সংশোধন আনা হয়েছে। ফলে প্রয়োগে বাংলা বইয়ে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন অনুসৃত হবে। তবে পরের দুই ভাগের (৮ মাস) বই বা শিখন উপাদানও অভিজ্ঞতাভিত্তিক করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এই শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জনে কাজ করছে একটি বিশেষ কমিটি। ওই কোর কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের অধ্যাপক এম তারিক আহসান বলেন, প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে মোটা দাগে কয়েকটি দিক চিহ্নিত করা যায়। শিক্ষার্থীরা কেবল শ্রেণিকক্ষেই শিখবে না, বাসায়, বাসার চারপাশ, স্কুলের চারপাশ বা বৃহত্তর সমাজেও তার শিখন উপাদান থাকবে। চিরাচরিত স্কুলের পরীক্ষা বিদায় নেবে। মূল্যায়ন মানেই পরীক্ষা নয়। এর পরিবর্তে শিশুর শিখন উন্নতি শিক্ষার্থীর বাবা-মা বা অভিভাবক, পরিবারের সদস্য, সমাজের সংশ্লিষ্ট অংশ, তার সহপাঠীও পরীক্ষকের ভূমিকায় থাকবেন। শিক্ষকের বা স্কুলের কাছে মূল্যায়নের অংশ থাকবে খুবই কম। আর এই মূল্যায়নে আগের মতো নম্বর দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে না। শিশুকে দেওয়া পাঠ কতটুকু শিখতে পেরেছে, সেই মন্তব্য করবেন উল্লিখিত চার স্তরের পরীক্ষকরা। এই মন্তব্য ‘খুব ভালো’, ‘ভালো’, ‘সন্তোষজনক’, ‘আরও শেখা দরকার’-এ ধরনের হবে। ফলে প্রথম-দ্বিতীয় হওয়ার দৌড় থাকবে না। এতে স্বজনপ্রীতির কোনো সুযোগ থাকবে না।
এই বিশেষজ্ঞ নতুন পাঠ্যবই বা পাঠের ধরন প্রসঙ্গে বলেন, মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্গম অঞ্চল হোক-শিক্ষার্থীর শিখন বা পাঠদান থেমে থাকবে না। বিশেষ করে মহামারির এই সময়ে যদি স্কুল বন্ধ থাকে, তাহলে অনলাইনে কার্যক্রম চালানো যাবে। যেখানে অনলাইনের সুযোগ নেই, সেখানে স্কুল তার শিক্ষার্থীকে গুচ্ছ ভাগ করে পাঠ পৌঁছে দেবে। যেখানে এটাও সম্ভব নয়, সেখানে স্থানীয় মসজিদ বা বাজার প্রভৃতি স্থানে পাঠদান পৌঁছে দেয়া যাবে। পরে সেখান থেকে অভিভাবক তা সংগ্রহ করে সন্তানের কাছে নেবেন। বেশির ভাগ কাজ চিত্রসম্বন্ধীয়। ফলে অভিভাবক নিরক্ষর হলেও তার সমস্যা সমাধানে অন্যের দ্বারস্থ হতে হবে না।
শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই তৈরির কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, নতুন পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাক্রম মুখস্থনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার উপযোগী করে তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে কোচিং ও নোট-গাইডনির্ভরতা কমে যাবে। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রথম শ্রেণি থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সংগতিবিধানের পরিকল্পনা আছে।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ১২ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করার পরিবর্তে পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতা তথা পরিবার ও সমাজে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে শেখার সুযোগ পাবে। পাশাপাশি নিজেরা বুঝে পড়ায় অভ্যস্থ হবে। এতে পড়ার চাপ ও লেখাপড়ায় মানসিক চাপ কমে যাবে। এটা হাতেকলমে শেখার রাস্তা উন্মুক্ত করবে। পাইলটিংয়ে প্রথমদিকে নানা ভুলভ্রান্তি উঠে আসতে পারে। তবে প্রতিটি ‘ফিডব্যাকই’ আমলে নিয়ে প্রয়োজনের নিরিখে তা চূড়ান্ত শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আর শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, নতুন এই পদ্ধতির সফল বাস্তবায়নে অভিভাবকসহ সমাজের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন দরকার হবে বলে মনে করেন তিনি।
উল্লেখ্য, ১৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা অনুমোদন দেন। সেটি অনুযায়ীই প্রণীত হয় শিক্ষাক্রম। পরে তৈরি হয়েছে পাঠ্যবই।
পরবর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ