করোনায় অ্যান্ডেমিকের পথে বাংলাদেশ : মহামারিতেও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক কার্যক্রম
মানুষের মধ্যে যে ভয় ছিলো এখন আর নেই : সাধারণ রোগ মনে করে স্বাভাবিক জীবনযাপন
স্টাফ রিপোর্টার: দেশে দীর্ঘ প্রায় দুই বছর ধরে চলা করোনা মহামারির সঙ্গে ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত হচ্ছে মানুষ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে দেয়া বিধিনিষেধ গুটিয়ে নেয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশেও কোভিড প্যান্ডেমিক (করোনা মহামারি) অ্যান্ডেমিকে (সাধারণ রোগ মনে করে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন) রূপ নিচ্ছে-এমন মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তবে এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ‘অ্যান্ডেমিক’ ঘোষণা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের আরও অভিমত-বিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্যান্ডেমিক থেকে অ্যান্ডেমিকের পথে যাচ্ছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে বিধিনিষেধগুলোতে শিথিলতা আনছে। বাংলাদেশেও সরকারিভাবে বিধিনিষেধ থাকলেও সাধারণ মানুষ করোনাকে অ্যান্ডেমিক ধরে সেদিকেই যাচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, অ্যান্ডেমিক হওয়া মানে মহামারি ঘোষিত কোনো ভাইরাস বা রোগের প্রকোপ কমে গিয়ে দীর্ঘকালীন সাধারণ ব্যাধি হিসাবে থাকবে। যার সঙ্গে মানুষকে ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে চলতে হবে। এটি কোনো কোনো স্থানে গুচ্ছভাবে হঠাৎ বাড়বে, আবার কোথাও কমবে। এটি থেকে বাঁচতে হলে টিকা দেয়া ও স্বাস্থ্যবিধি মানানোসহ দীর্ঘমেয়াদি কৌশল অবলম্বন ও পরিকল্পনা করে চলতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, করোনা সংক্রমেণর প্রথমদিকে মানুষের মধ্যে ভাইরাসটি নিয়ে যে ভয় ছিল, এখন আর তা নেই। এটাকে স্বাভাবিক রোগ মনে করছে। আবার এটি কোনোদিন যাবে কিনা জানতে পারছে না। মানুষ ভাবছে ভাইরাসটি থাকবে, জীবনও বাঁচাতে হবে। এখন শীতকালে স্বাভাবিকভাবেই ঠান্ডা-জ্বর হয়। করোনার বর্তমান উপসর্গও এমন। মানুষ মনে করছে করোনা সাধারণ রোগ হিসাবেই থাকবে। যাকে প্যান্ডেমিক থেকে অ্যান্ডেমিকের সঙ্গে তুলনা করছে। তবে এটা সত্য যে, বাংলাদেশসহ বিশ্বে যেভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। এক পর্যায়ে এটা মানুষের শরীরে ন্যাচারাল ইমিউনিটি তৈরি করবে। অন্যদিকে টিকা দেওয়া হচ্ছে। এই দুইয়ের সমন্বয়ে এক সময় একেবারেই চলে যাবে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত অ্যান্ডেমিক বলা যাবে না।
বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, করোনাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের চলতে হবে। তবে এটি কোন কোন জায়গায় কী ধরনের গুচ্ছ সংক্রমণ, কত মৃত্যু হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দেখা যাবে কোন কোন জায়গায় সংক্রমণের পিক (সর্বোচ্চ চূড়ায় গিয়ে কিছুদিন স্থিতিশীল থাকা) পৌঁছেছে। টিকাদানের জন্য তা নামতে শুরু করবে। আবার কোনো জায়গায় প্রাকৃতিকভাবে কমতে শুরু করবে। এটা নিয়েই সবাইকে বাঁচতে হবে। যাকে অ্যান্ডেমিক সাধারণ রোগ হিসাবে গণ্য করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে নিউজিল্যান্ড জিরোভ্যাক্স কোভিড বা শূন্য কোভিড আইডিয়া বাদ দিয়েছে। চীন অলিম্পিক গেমস পর্যন্ত দেখবে বলছে। কারণ জিরো কোভিড আইডিয়া টিকা দিয়ে শেষ হবে না বলে উন্নত বিশ্বগুলো বুঝে গেছে। আর করোনা সঙ্গে নিয়েই যেহেতু বাঁচতে হবে। সেজন্য কৌশল অবলম্বন করতে হবে। এজন্য মাস্ক পরিধান, দ্রুত টিকা নেওয়া, কোমরবিডিতে ভোগা রোগীদের সাবধানতা অবলম্বন, ভেন্টিলেশন ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে হবে।
এদিকে বাংলাদেশে ভাইরাসটিতে এ পর্যন্ত ১৮ লাখ ৪৪ হাজার ৮২৮ জন আক্রান্ত ও ২৮ হাজার ৫২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। সরকারি হিসাবে করোনা শনাক্ত-পরবর্তী ১৫ লাখ ৮৭ হাজার ৩৭৪ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। ভাইরাসটি মোকাবিলায় সরকার বিভিন্ন সময় বিধিনিষেধ দিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেউই মানছে না। করোনার অতিসংক্রামক ধরন ওমিক্রনেও ভয় পাচ্ছে না মানুষ। সবকিছু স্বাভাবিক চলছে।
জনস্বাস্থ্যবিদরা আরও বলছেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে সার্বিকভাবে বিধিনিষেধ দিলেও এ দেশের মানুষ তা পুরোপুরি মানবে না-চলমান পরিস্থিতি তাই ইঙ্গিত করছে। কারণ এতে সামাজিক, অর্থনৈতিক সব খাতেই বিরূপ প্রভাব পড়ে। কিন্তু এটি কমাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকাদানে গুরুত্ব দিতে হবে। এখনো যারা টিকার আওতায় আসেনি তাদের খুঁজে খুঁজে টিকা দিতে হবে। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ টিকাকেন্দ্র চালু করতে হবে। উপসর্গযুক্তদের বাড়িতে চিকিৎসা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করতে হবে। মারাত্মক অসুস্থ রোগীদের হাসপাতালে নিতে হবে। যাদের দীর্ঘমেয়াদি রোগ আছে তাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। ঘরোয়া পরিবেশে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে।
করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার যে বিধিনিষেধ দিয়েছে। এর মধ্যে যেগুলো বাস্তবায়নযোগ্য বিশেষ করে ‘ইনডোর’ সেগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জোর দিতে হবে। কারণ এই মুহূর্তে ‘আউটডোর’ তথা বাজারঘাট, শপিংমল, মেলা, বিনোদনকেন্দ্র যেখানে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে গুরুত্ব দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এখানে অন্তত মাস্ক পরিধান ও ভেন্টিলেশন (বাতাস চলাচল ব্যবস্থা) অপরিহার্য করা দরকার। এতে সংক্রমণঝুঁকি কমবে।
অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী আরও বলেন, টিকা দেওয়া ও স্বাস্থ্যবিধি মানানোসহ দীর্ঘমেয়াদি কৌশল অবলম্বন ও পরিকল্পনা করে চলতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের মধ্যে প্রধান হলো প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে উন্নত করা। যাতে করে রোগীদের সর্দি-হাঁচি-কাশি, ঠান্ডা লাগা, গলাব্যথা হলেও চিকিৎসা নিশ্চিত হয়। এছাড়া গ্রামে স্বাস্থ্যকর্মীদের হোম ভিজিট, কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হেলথ ম্যানেজমেন্ট জোরদার করতে হবে। আরবান হেলথ কেয়ার অর্থাৎ নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রসেবা পরিধি বাড়াতে হবে। কারণ নগর অঞ্চলে ৪০ শতাংশ মানুষ বাস করে। তাদের জন্য সেখানকার চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করা জরুরি। তাতে বড় হাসপাতালে চাপ কমবে। সার্বিকভাবে হেলথকেয়ার সিস্টেমের ওপর চাপ কমবে। এভাবে সমন্বিতভাবে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে মাল্টি সেক্টরাল অ্যাপ্রোচ অর্থাৎ সরকারের সবগুলো দপ্তর ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও কাজ করতে হবে। এভাবে প্যান্ডেমিককে অ্যান্ডেমিক ধরে এগিয়ে যেতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, অ্যান্ডেমিক হচ্ছে কোন এলাকায় মহামারির স্বল্পপ্রবণ সংক্রমণ। এমন মাত্রার সংক্রমণ যা স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে না। একসঙ্গে অনেক মানুষকে আক্রান্ত করে না। বর্তমানে কলেরা, ডায়রিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ এমন অনেক রোগ দেশে আছে, যা প্যান্ডেমিক থেকে অ্যান্ডেমিক পর্যায়ে রয়েছে। এতে কারও তেমন ক্ষতি হয় না। এর থেকে ভালো থাকার উপায় সবাইকে টিকা দেওয়া ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।
তিনি বলেন, আমরা কোভিড প্যান্ডেমিককে অ্যান্ডমিকের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। কারণ আমাদের এখানে সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা কোনো কাজে আসেনি। দেশের ৪০ ভাগ মানুষ ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছে। যদি ৭০ শতাংশ মানুষ অল্পদিনের মধ্যে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে যায় তাহলে একটা বড়সংখ্যক জনসংখ্যার মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে। আমরা স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারব। তখন অ্যান্ডেমিকের দিকে যাব। আর এটা এমনি এমনিই হয়ে গেছে। এটা যদি বৈজ্ঞানিকভাবে হতো, ভালো হতো। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এগোতে হলে সরকারের সব প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
তবে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এখনো বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন শনাক্ত ও মৃত্যু বাড়ছে। সাধারণ মানুষ বিধিনিষেধকে আমলে নিচ্ছেন না সত্য। ফলে এককভাবে অ্যান্ডেমিকের সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। এটি কমার পর যে কোনো মুহূর্তে মাথাচাড়া দিতে পারে সে ঝুঁকি আছে। তাই ডব্লিউএইচও কর্তৃক ঘেষণা না আসা পর্যন্ত অ্যান্ডেমিক বলা যাবে না।
উল্লেখ্য সম্প্রতি ইংল্যান্ড ঘোষণা দিয়েছে, সেদেশে আর বাধ্যতামূলক মাস্ক পরতে হবে না। জনসমাবেশস্থলে যেতেও আর কোভিড পাশ লাগবে না। স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ড একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া টিকা কার্যক্রমে সফলতা পাওয়ায় ওমিক্রন আতঙ্কের মধ্যেও ১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ডেনমার্ক।
চলতি জানুয়ারিতে করোনা বিধিনিষেধ শিথিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া ও আয়ারল্যান্ড। এ ঘোষণার ফলে দোকানপাট, ব্যায়ামাগার ও সেলুন খুলে দেওয়া হবে।
এদিকে গত ২৮ জানুয়ারি ইউনিসেফ স্কুল খুলে দেওয়ার আহ্বান জানায়। এ ধারাবাহিকতায় ভারতের দিল্লিতে বন্ধ থাকা স্কুল, কলেজ, কোচিং ইনস্টিটিউটসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগামী সোমবার (৭ ফেব্রুয়ারি) থেকে খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শুক্রবার দিল্লিতে সরকারের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।
দিল্লির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (ডিডিএমএ) জানিয়েছে, জিম, সুইমিংপুল এবং স্পা সেন্টারগুলোও পুনরায় চালু হবে আগামী সপ্তাহ থেকে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ধাপে ধাপে স্কুলগুলো খুলে দেওয়া হবে। আর ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সশরীর পাঠদান শুরু হবে।