নজরুল ইসলাম: বেঁচে থাকার জন্যে প্রতিটি মানুষকে জীবনযুদ্ধে নামতে হয়। জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার প্রধান পথ হচ্ছে পরিশ্রম। কর্মই জীবন। জীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্যে মানুষকে কর্মমুখর জীবন কাটাতে হয়। মানবজীবনের যে উৎকর্ষ সাধিত হচ্ছে এবং মানব সভ্যতার যে বিকাশ ঘটছে তাতে কর্মের গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষ শ্রম দেয় বলেই সভ্যতার চাকা ঘোরে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তবে সুখের মুখ দেখতে হয়। বর্তমান বিশ্বের যা কিছু অগ্রগতি তা মানুষের কর্মদানের অবদান। কাজের প্রকারভেদের কারণে মানুষের মধ্যে শ্রেণি বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে কেউ অল্প পরিশ্রমে বেশি সুখ ভোগ করছে, কেউ সর্বাধিক শ্রম দিয়েও ন্যূনতম সুখ পাচ্ছে না। নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠা এবং মাঠের কৃষিকাজ যান্ত্রিক হওয়ায় বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই ক্লান্তি শেষে একটু সুখ এবং পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে খেটে খাওয়া মানুষেরা শারীরিক পরিশ্রমের পথ হিসেবে অবলম্বন করেছেন ব্যাটারি ও ইঞ্জিনচালিত যানবাহন। আর এসব যানবাহন কিনতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েছেন এনজিওর ঋণে। একদিকে এনজিওর কিস্তি অপরদিকে যাত্রীর চাইতে বৃদ্ধি পেয়েছে যানবাহনের সংখ্যা। ফলে মাথা থেকে ঋণের বোঝা না কমলেও কমেছে রোজগার। সাপ্তহে কিস্তির দিন ঘনিয়ে আসলে কপালে ভাজ পড়ে অনেকেরই।
কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র না থাকায় চুয়াডাঙ্গা জেলার এক শ্রেণির মানুষ জীবন ও জীবিকার জন্য অবলম্বন হিসেবে বেঁচে ক্রয় করেছেন আলমসাধু, নছিমন, করিমন, লাটাহাম্বার, পাখিভ্যান, ইজিবাইকসহ নানা রকম যানবাহন। এসব যানবাহনের অধিকাংশ মালিকেরা সুদের ওপর টাকা নিয়ে অথবা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কিনেছেন এসব বাহন। বর্তমানে একটি পাখিভ্যানের দাম ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। ইজিবাইকের দাম ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে ২ টাকার মতো। দরিদ্র এসব মানুষের সংসারে এমন কোনো সম্পদ নেই যে, তা বিক্রি করে কিনবে। কোনো উপায়অন্ত না পেয়ে শেষমেষ এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কিনছেন ব্যাটারী কিংবা ইঞ্জিনচালিত এসব বাহন। আর এসব বাহন চালিয়ে সংসারের হাল ধরেছেন ১০ বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধ। চুয়াডাঙ্গা ডিহি গ্রামের আব্দুল্লাহ (১২)। সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। বাবা বেঁচে না থাকায় লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসারের হাল ধরেছে সে। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে মা কিনে দিয়েছেন পাখিভ্যান। সারাদিন ঘুরে ঘুরে ৩শ থেকে ৪শ টাকা ভাড়া মারে। তাই দিয়ে চলে তাদের সংসার। দ্রম্যমূল্যের এ উর্ধ্বগতির কারণে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। দোস্ত গ্রামে সাইফুল ঋণ নিয়ে কিনেছেন পাখিভ্যান। সাপ্তাহের বৃহস্পতিবার কিস্তি। কিস্তির দিন ঘনিয়ে এলেই ২ হাজার টাকার জন্য কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ পড়ে যায় তার। অটোচালক কুড়ালগাছি গ্রামের আব্দুর রহমান (৬৫) জানালেন, যাত্রীর চাইতে গাড়ি বেশি। গাড়ি এখন পায়ে পায়ে। প্রথম দিকে মানুষ ছুটতো এসব যানবাহনের দিকে। এখন যানবাহন ছুটছে মানুষের দিকে। একজন যাত্রী হলে ছুটতে হয় গন্তেব্যে। সারাদিনে ভাড়া হয় ৩-৪শ টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুত খরচ ৮০ থেকে ১শ টাকা। ব্যাটারীর কথা বাদই দিলাম; বড় ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি হলে ধারকর্জ করে সারতে হয় গাড়ি। এরকম যানবাহন চালানো সাকের আলী, মজিবর, জসিম, গণি, রবজেল, রমজান, তোরাপ আলী জানালেন, বর্তমানে পাখিভ্যানের ব্যাটারির দাম ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। আর ইজিবাইকের ব্যাটারির দাম ৬০ হাজার টাকা। ব্যাটারী নষ্ট হলে এক এনজিও থেকে লোন নিয়ে গাড়ি কেনা আর অন্য এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ব্যাটারি কেনা ছাড়া কোনো উপায় নেই। সুদের টাকায় এসব গাড়ি কিনে কেউ সুখে নেই। এমনও আছে একজন ব্যক্তি একাধিক এনজিও থেকে লোন নিয়ে দিনদিন তার ঋণের বোঝা ভারি হয়েই চলেছে। বর্তমানে এসব গাড়ি চালানো কোনো মানুষ সুখে নেই। সাপ্তাহে হয় কিস্তির টাকা না হয় মাস শেষে মহাজনের সুদের টাকার জোগান দিতেই হয়। আমাদের জেলাতে কর্মসংস্থানের তেমন ক্ষেত্র না থাকায় এ পথ বেছে নিতে হয়েছে অনেককেই। গরীব হচ্ছে আরো গরীব। বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটি মানুষকে কোনো না কোন কর্ম করতে হয়। একথা অনস্বীকার্য যে সবাইকে কর্ম দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। তাই খেটে খাওয়া এসব মানুষের সুদবিহীন সরকারি সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো প্রয়োজন। তাহলে শ্রমের প্রতি যেমন সম্মান দেখানো হবে তেমনি দিন শেষে কর্মমুখি এসব মানুষ রাতে অন্তঃত নিশ্চিন্তে বালিশে মাথা রেখে একটু ঘুমাতে পারবে।
পূর্ববর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ