স্টাফ রিপোর্টার: শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ খুন হওয়ার পর মাস না ঘুরতেই ফের আততায়ীদের ব্রাশফায়ারে কক্সবাজারের উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে। শুক্রবার ভোরে দুষ্কৃতকারীদের এলোপাতাড়ি গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে সেখানকার একটি মাদরাসার ৭ জন ছাত্র-শিক্ষক নিহত এবং অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। এ সময় পুলিশ হামলাকারীদের একজনকে একটি দেশীয় লোডেড ওয়ান শুটারগান, ছয় রাউন্ড গুলি ও একটি ছুরিসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করেছে। একের পর এক নৃশংস হত্যাকান্ডে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে সরকারেও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। দুষ্কৃতকারীদের হামলায় নিহতরা হলেন ওই মাদরাসার শিক্ষক ১২ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. ইদ্রিস (৩২), নয় নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা ইব্রাহিম হোসেন (২৪), মাদ্রাসার ছাত্র ও ১৮ নম্বর ক্যাম্পের আজিজুল হক (২২), একই ক্যাম্পের ভলেন্টিয়ার মো. আমীন (৩২), মাদ্রাসার শিক্ষক ও ১৮ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা নুরুল আলম ওরফে হালিম (৪৫), মাদ্রাসার শিক্ষক ও ২৪ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা মৌলভি হামিদুল্লাহ (৫৫) এবং নূর মোহাম্মদের ছেলে মাদরাসার ছাত্র নূর কায়সার (১৫)। এদের মধ্যে চারজন ঘটনাস্থলেই মারা যান। বাকি তিনজনের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রত্যাবাসন-বিরোধীরাই রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করেছে বলে তার সহকর্মী ও গোয়েন্দারা প্রাথমিকভাবে ধারণা করলেও শুক্রবার ভোরে কারা কী উদ্দেশ্যে মসজিদে গুলি চালিয়ে নিরীহ মুসল্লিদের হত্যা করেছে তা এখনো অজানা রয়েছে। তবে স্থানীয়রা অনেকে মনে করেন, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ীরা নিজেদের ক্ষমতার জানান দিতে বর্বরোচিত এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। আবার কারও কারও ধারণা, প্রত্যাবাসন নিয়ে স্বার্থের দ্বন্দ্বে একটি গোষ্ঠী এ অপতৎপরতা চালিয়েছে।
এদিকে রোহিঙ্গাদের অপর একটি সূত্র জানায়, ক্যাম্পে ইসলামী মাহাত গ্রুপ ও আরসা গ্রুপ নামের দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আরসা গ্রুপের কার্যকলাপ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা এখন ক্যাম্পে তাদের সংগঠনের কার্যকলাপ এক তরফাভাবে চালাতে গিয়ে মূলত প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘাতে জড়ায়। এ ছাড়া ইসলামী মাহাত গ্রুপ ক্যাম্পে একটি মাদ্রাসা পরিচালনা করে। সেখানেও নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করে আরসা গ্রুপ। সম্প্রতি আরসা গ্রুপের কয়েকজন সদস্যকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করে মাহাত গ্রুপ। এর জের ধরে এই গুলির ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক পুলিশ সুপার মো. শিহাব কায়সার খান জানান, শুক্রবার ভোর ৪টার দিকে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের ১৮ নম্বর ময়নারঘোনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এই হামলা হয়। নিহতরা সবাই ওই ক্যাম্পের এইচ-৫২ ব্লকের।
‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ’ মাদরাসার শিক্ষক, ছাত্র ও ভলেন্টিয়ার। এ হামলায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতারকৃত মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে একটি ওয়ান শুটারগান, ৬ রাউন্ড গুলি ও একটি ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে।
এপিবিএন কর্মকর্তারা জানান, ময়নারঘোনা পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যরা বৃহস্পতিবার রাতে স্থানীয় ‘মদুতুল উম্মা’ মাদ্রাসা ও আশপাশের এলাকায় প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে ‘ব্লকরেইড’ চালায়। অন্যান্য ক্যাম্প এলাকাতেও একই সঙ্গে অভিযান চালানো হয়। এর ঘণ্টা দেড়েক পর দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ মাদ্রাসায় ওই হামলা হয়।
স্থানীয়ভাবে পাওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, ওই মাদ্রাসার মেঝেতে রক্ত ছড়িয়ে আছে। নিহতদের স্বজনরা সেখানে বিলাপ করছেন। একটি ছবিতে মাদ্রাসার পাশে হাতের দুটো কাটা আঙুল পড়ে আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৮ এপিবিএনের ময়নারঘোনা ক্যাম্পের এক কর্মকর্তা বলেন, মাদ্রাসা ও মসজিদের চারদিকের অংশে শুধু গুলির চিহ্ন। আর দা দিয়ে টিনের শেড কুপিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে। ঘটনাস্থলে অনেক মুসল্লির কর্তনকৃত আঙুলের অংশ পাওয়া গেছে।
কক্সবাজার ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) বলেন, কী কারণে এ হামলা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। অস্ত্রসহ একজনকে আটক করা হয়েছে। আশা করছি, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এ হামলার নেপথ্য কারণ জানা যাবে।
স্থানীয়রা জানান, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে পরিণত হওয়া কক্সবাজারের এই ক্যাম্পগুলোতে এর আগেও বিভিন্ন সময়ে গোলাগুলি ও সংঘর্ষ হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেগুলোকে ‘রোহিঙ্গা ডাকাত’ বা ‘চোরাকারবারিদের’ কাজ বলা হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। তবে রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ খুন হওয়ার পর ক্যাম্পে সক্রিয় বিভিন্ন পক্ষের অনেক বিষয় এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোচনায় আসছে।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কুতুপালং-১ (ইস্ট) লম্বাশিয়া ক্যাম্পের ডি-৮ ব্লকে গুলি করে হত্যা করা হয় মুহিবুল্লাহকে, যিনি আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস নামের একটি সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন। পরিবারের অভিযোগ, প্রত্যাবাসনের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করা মুহিবুল্লাহকে রোহিঙ্গাদের আরেকটি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) হত্যা করেছে।
এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একের পর এক হত্যাকান্ড ও গোলাগুলির ঘটনায় সরকারে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ‘অস্থিরতা’ তৈরির চেষ্টায় ‘মিয়ানমার থেকে বিভিন্নভাবে অস্ত্র আসছে’ বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মন্তব্য করেছেন।
অন্যদিকে রোহিঙ্গা শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ খুনের পর শুক্রবার সন্ত্রাসী হামলায় ৭ জন নিহত হওয়ার ঘটনাটি চরম উদ্বেগের বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা স্থানীয়দের বরাত দিয়ে জানান, মুহিবুল্লাহকে হত্যাকান্ডের নেতৃত্ব দিয়েছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। ঘাতকদের কয়েকজন আরসার ‘ছায়া সংগঠন’ ‘আল-ইয়াকিন’-এর সদস্য। অথচ রোহিঙ্গা শিবিরে ‘আরসার’ উপস্থিতি দাবি করা হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো তা বরাবরই নাকচ করে আসছে।
পূর্ববর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ