সবকিছুই নির্ভর করে সময়মতো টিকা পাওয়ার ওপর : স্বাস্থ্যমন্ত্রী
স্টাফ রিপোর্টার: দেশের এক কোটি মানুষকে গণটিকার আওতায় প্রথম ডোজ দেয়ার পর দ্বিতীয়টি নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে মজুদ আছে এক কোটি সাত লাখ টিকা। এক সপ্তাহে এক কোটি ডোজ দেওয়া হলে সরকারের কাছে মজুদ বলতে তেমন কিছুই থাকবে না। সহসাই বড় চালান আসার খবরও নেই। কাজেই এ কর্মসূচির আওতায় প্রথম যাদের দেয়া হবে তাদের দ্বিতীয় ডোজের সংস্থান নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া চার সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হবে। তখন এই সাত দিনের কর্মসূচি (গণটিকাদান) থাকবে না। সে সময় নতুন কোনো কর্মসূচি ঘোষণা হবে কিনা, না হলে এরা দ্বিতীয় ডোজ কোথায় টিকা নেবেন সে প্রশ্নেরও সুরাহা হয়নি। এ অনিশ্চয়তা দূর করতে এখনই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
এ অবস্থায় আগামী শনিবার থেকে দেশব্যাপী গণটিকাদান শুরু হচ্ছে। তবে এখানে ১৮ বছরের বেশি বয়সিদের গণহারে টিকা দেয়া হবে না। এখানে গর্ভবতী এবং দুগ্ধদায়ীদেরও টিকা দেয়া হবে না। পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাদান চলবে ৪ দিন। সিটি করপোরেশনে ৬ দিন ধরে চলবে এ কর্মসূচি। এজন্য ৫০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক নেয়া হয়েছে। ইপিআই কর্মীরা টিকা দেবেন। ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৩ হাজার ৮০০ ওয়ার্ডে ৪ দিনে ৫৫ হাজার ২০০ সেশনে ২০০ ডোজ করে মোট এক কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার টিকা দেয়া হবে। পৌরসভাগুলোর ১০৫৪টি ওয়ার্ডে ৪ দিনে ৪২১৬টি সেশনে ২০০ ডোজ করে ৮ লাখ ৪৩ হাজার ২০০ ডোজ টিকা দেয়া হবে। সিটি করপোরেশনগুলোতে ৪৩৩টি ওয়ার্ডে ৬ দিনে ৭৭৯৪ সেশনে ২০০ ডোজ করে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ৮০০ ডোজ দেয়া হবে। সব মিলিয়ে ১৫ হাজার ২৮৭টি ওয়ার্ডে ৬৯ হাজার ৩১৮ সেশনে এক কোটি ৩৪ লাখ ৪২ হাজার ডোজ টিকা দেয়ার মতো সক্ষম জনবল এবং পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই জনবল কাজে লাগিয়ে মোট এক কোটি ডোজ টিকা দেয়া হবে। এ পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন ১ কোটি ৬৬ লাখ ৮৯ হাজার ৩৫ জন। নিবন্ধন ছাড়াও ক্যাম্পে এনআইডি নিয়ে গেলেই দেয়া হবে প্রথম ডোজ। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বুধবার বিকেলে মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, শনিবার থেকে দেশজুড়ে টিকাদান শুরু হবে। এতে জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সংযুক্ত থাকবে। কর্মসূচির মূল লক্ষ্য বয়স্কদের টিকার আওতায় আনা। কারণ তাদের মধ্যে টিকা নেয়ার প্রবণতা কম এবং করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুও বেশি। তবে বয়স্কদের পাশপাশি অন্যরাও টিকা পাবেন। টিকাদান সহজ করতে এনআইডি কার্ড দেখালেই হবে। পরে এনআইডিগুলো নিবন্ধনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, এখনই ১৮-ঊর্ধ্ব সবাইকে টিকা দেয়া সম্ভব হবে না। বর্তমানে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সি শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া ফন্টলাইনার হিসাবে যারা কর্মরত তাদের পরিবারের সদস্যরা টিকা পাবেন। টিকাদানের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়স ২৫ বছর। তবে পর্যায়ক্রমে ১৮-ঊর্ধ্ব সবাইকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের হাতে এক কোটির ওপর টিকা রয়েছে। চায়না, ভারত, কোভ্যাক্স এবং রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছে। এ মাসেই আরও টিকা আসবে। বর্তমানে চায়না এবং কোভ্যাক্স থেকে আমরা নিয়মিত টিকা পাচ্ছি। এ মাসে সেরাম থেকে টিকা পাঠানোর ইঙ্গিত রয়েছে। আশা করছি টিকা প্রাপ্তিতে আর সমস্যা হবে না। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় আগের মতো কোনো বিপত্তি ঘটলে সেক্ষেত্রে কিছুই করার থাকে না। জাহিদ মালেক বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, কোনো দেশে টিকাদানের মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করতে হলে অবশ্যই ৮০ শতাংশ মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। দেশে ৮০ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে সময়মতো টিকা পাওয়ার ওপর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে ১১ কোটি ৭৮ লাখ ৫৬ হাজার মানুষকে টিকার আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ মোট জনগোষ্ঠী ৮০ শতাংশ, যাদের বয়স ১৮ বছরের বেশি। এ পর্যন্ত নিবন্ধনের আওতায় এসেছেন ১৪ শতাংশ বা এক কোটি ৬৫ লাখ ২৩ হাজার ২৭০ জন। প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৯৩ লাখ ৯৮ হাজার ৭৭৩ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪৩ লাখ ৬৫ হাজার ৩৮৯ জন। অর্থাৎ প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৮ শতাংশ এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন মাত্র ৪ শতাংশ। দেশে বর্তমানে টিকা গ্রহীতার হার প্রথম ডোজপ্রতি ১০০ জনে ৫ দশমিক ৪৪ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ ২ দশমিক ৫২ জন।
অন্যদিকে ক্যাম্পেইন পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, দেশে গ্রামাঞ্চলে ১৩ হাজার ৮০০ ওয়ার্ডে ৪ দিনে ৫৫ হাজার ২০০ সেশনে ২০০ ডোজ করে মোট এক কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার টিকা দেয়া হবে। সিটি করপোরেশনগুলোতে ৪৩৩টি ওয়ার্ডে ৬ দিনে ৭৭৯৪ সেশনে ২০০ ডোজ করে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ৮০০ ডোজ দেওয়া হবে। দেশের পৌরসভাগুলোর ১০৫৪টি ওয়ার্ডে ৪ দিনে ৪২১৬টি সেশনে ২০০ ডোজ করে ৮ লাখ ৪৩ হাজার ২০০ ডোজ টিকা দেয়া হবে। সব মিলিয়ে ১৫ হাজার ২৮৭টি ওয়ার্ডে ৬৯ হাজার ৩১৮ সেশনে এক কোটি ৩৪ লাখ ৪২ হাজার ডোজ টিকা দেয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ পর্যন্ত টিকা দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৪০ লাখ ৮৯ হাজার ২০১ ডোজ। এর মধ্যে এক ডোজ নিয়েছেন ৯৬ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৭ জন। দুই ডোজ নিয়েছেন ৪৩ লাখ ৯১ হাজার ৭৮৪ জন। এগুলো দেওয়া হয়েছে অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকার ফর্মুলায় ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি কোভিশিল্ড, চীনের তৈরি সিনোফার্ম, ফাইজার এবং মডার্নার টিকা। মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সারা দেশে ৩ লাখ ২২ হাজার ৪৪৩ ডোজ টিকা দিয়েছে। মঙ্গলবার অ্যাস্ট্রাজেনেকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১১ হাজার ৮৯৮ জন। এখন পর্যন্ত অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৮ লাখ ২০ হাজার ৫৩ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪৩ লাখ ১৮ হাজার ৭৮৫ জন। ফাইজারের প্রথম ডোজ দেয়া হয়েছে প্রায় ৫৩ হাজার। এ পর্যন্ত দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন এক হাজার ২৬ জন। সব মিলে ফাইজার দেয়া হয়েছে ৫৪ হাজার ৪৪৯ ডোজ। মডার্নার টিকা এখন পর্যন্ত দেয়া হয়েছে ৯ লাখ ২৬ হাজার ২৬৩ ডোজ, শুধু মঙ্গলবার দেয়া হয়েছে ৮২ হাজার ৫৪ ডোজ।
গণটিকা কর্মসূচির আওতাভুক্ত এক কোটি ডোজের বাইরে আরও চাহিদা আছে। তৈরি পোশাক শিল্প মালিক সমিতি ৮০ লাখ ডোজ টিকা চেয়েছে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, প্রবাসীসহ বিভিন্ন পর্যায়ে টিকার চাহিদা দেয়া হয়েছে। এগুলো জোগান দিতে গেলে আরও অনেক টিকা প্রয়োজন। কিন্তু এ মুহূর্তে সরকারের হাতে আছে এক কোটি সাত লাখ ডোজ। নতুন করে টিকা না আসা পর্যন্ত কারও চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে টিকা নেয়া ছাড়া ১৮ বছরের ওপরের কেউ বাইরে বের হতে পারবে না বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের যে বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে, তা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নয়। এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোথাও দেয়া বা নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে নিজের দেয়া ওই বক্তব্য প্রত্যাহার করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। এর আগে মঙ্গলবার সচিবালয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের বৈঠক শেষে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল বলেছিলেন, ১১ আগস্টের পর টিকা ছাড়া কেউ মুভমেন্ট করলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। আইন না করলেও অধ্যাদেশ জারি করে হলেও শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা দেয়া হবে।
এদিকে চট্টগ্রামের পটিয়ায় ইউনিয়ন পর্যায়ে আগাম টিকা দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে অভিযুক্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ইপিআই) মো. রবিউল হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকালে তাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বরখাস্ত করা হয়। তবে রবিউলকে বরখাস্তের চিঠি এখনো জেলা সিভিল সার্জন পাননি বলে জানিয়েছেন। সিভিল সার্জন শেখ ফজলে রাব্বি বলেন, শুনেছি রবিউল হোসেনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনো চিঠি আসেনি।
অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রবিউলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সরকারি নির্দেশনার আগে ৩০ ও ৩১ জুলাই পটিয়া উপজেলার শোভনদন্ডী ইউনিয়নে নিবন্ধন ছাড়া দুই হাজার ৬০০ জনকে করোনার টিকা দেন। গত ৩০ জুলাই শোভনদন্ডী ইউনিয়নের আরফা করিম উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং পরদিন শোভনদন্ডী স্কুল অ্যান্ড কলেজে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টিকা দেওয়া হয়। পরে এ ঘটনায় শনিবার (৩১ জুলাই) সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. অজয় দাশকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটিকে দুই দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়। তদন্ত শেষে গত সোমবার কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়।