স্টাফ রিপোর্টার: দেশে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে করোনা। প্রাণঘাতী এ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ঢাকার আশপাশের সাত জেলাসহ দেশের অনেক স্থানে চলছে ‘লকডাউন’। কিন্তু তাতেও থামছে না করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু। প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে সারাদেশে কমপক্ষে ১৪ দিনের পূর্ণ ‘শাটডাউনের’ সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। লকডাউন এবং কঠোর লকডাউনের মতো শাটডাউনেও থাকতে পারে কঠোর থেকে কঠোরতর বিধিনিষেধ। এসময় জরুরি সেবা বাদে বাকি সব বন্ধ থাকবে। গতকাল বৃহস্পতিবার কোভিড কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি এ তথ্য জানানো হয়েছে। শাটডাউন মানে হচ্ছে সবকিছু বন্ধ থাকবে, শুধু জরুরি সেবা ছাড়া। অফিস-আদালত, বাজার-ঘাট, গণপরিবহণসহ সব বন্ধ থাকবে। সবাই বাসায় থাকবে। এমনটাই জানিয়েছেন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ। তিনি বলেন, জরুরি সেবা বলতে ওষুধ, ফায়ার সার্ভিস, গণমাধ্যম ছাড়া সবকিছু দুই সপ্তাহ বন্ধ করে মানুষ যদি এই স্যাক্রিফাইস-কষ্টটুকু মেনে নেয়, তাহলে আগামীতে ভালো হবে।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ জানান, দিল্লি এবং মুম্বাইতে শাটডাউন দিয়ে ফলাফল পেয়েছে। সেখানে ৬ সপ্তাহ গণপরিবহন বন্ধ ছিলো, এছাড়া দিল্লিতে আরও ৩ সপ্তাহ ছিলো। দিল্লিতে প্রতিদিন একসময় ২৮ হাজার শনাক্ত হতেন, কিন্তু এখন সেখানে ১৫০ শনাক্ত হচ্ছেন। মৃত্যুও কমে এসেছে। কোভিড কারিগরি পরামর্শক কমিটির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ রোগের বিশেষ ডেল্টা প্রজাতির সামাজিক সংক্রমণ চিহ্নিত হয়েছে ও দেশে ইতোমধ্যেই রোগের প্রকোপ অনেক বেড়েছে। এ প্রজাতির জীবাণুর সংক্রমণ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে সারা দেশেই উচ্চ সংক্রমণ, ৫০টির বেশি জেলায় অতি উচ্চ সংক্রমণ লক্ষ্য করা যায়। রোগ প্রতিরোধের জন্য খ- খ- ভাবে নেয়া কর্মসূচির উপযোগিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকার করোনা পরিস্থিতি খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় যে কোনো সময় যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি সারা দেশে ১৪ দিনের শাটডাউনের সুপারিশ করেছে, বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায় নেয়া হবে। সারা দেশে শাটডাউনের প্রস্তুতি সরকারের রয়েছে। আগের চেয়ে বিধিনিষেধ আরও কঠোর হবে। তিনি বলেন, সংক্রমণ যেহেতু বেড়ে যাচ্ছে, আমরা বিভিন্নভাবে তা কমানোর চেষ্টা করছি। স্থানীয়ভাবে বিধিনিষেধ দিয়ে এটাকে কন্ট্রোলের (নিয়ন্ত্রণ) চেষ্টা চলছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে যেটা প্রয়োজন হবে সেটাই আমরা করবো।
এদিকে সীমান্ত এলাকার পাশাপাশি রাজধানী ও আশপাশের জেলায় ঢুকে পড়েছে করোনা। ঢাকার হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে নতুন রোগীর ভিড়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক সপ্তাহে দেশের সব বিভাগে নতুন শনাক্তের হার বেড়েছে। এ সময়ে ঢাকা বিভাগে করোনা সংক্রমণ বেড়েছে সর্বোচ্চ ১১৪ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। এরপর রয়েছে রংপুর বিভাগ। সেখানে সংক্রমণ বেড়েছে ৮৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৪০টিই সংক্রমণের অতি উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। সোমবার মধ্যরাত থেকে লকডাউন দেয়া ঢাকার আশপাশে সাত জেলায়ও বাড়ছে সংক্রমণ। ২৪ ঘণ্টায় গাজীপুরে শনাক্তের হার ২৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। আগের দিন এ হার ছিল ২০ দশমিক ৪৭ শতাংশ। মাদারীপুরে শনাক্তের হার ৫৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আগের দিন এ হার ছিল ৪৪ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। গোপালগঞ্জে শনাক্তের হার ৫০ শতাংশ। বুধবার এ হার ছিল ৪৪ দশমিক ২১ শতাংশ। ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা জেলায় (মহানগরসহ) শনাক্তের হার ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ।
এদিকে ২৪ ঘণ্টায় দেশে মৃত্যু কিছুটা কমলেও বেড়েছে সংক্রমণ। এ সময়ে আরও ৬০৫৮ জনের মধ্যে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে। যা আড়াই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। আগের দিন শনাক্ত হয়েছিল ৫০৭২৭ জন। একদিনে আক্রান্তদের মধ্যে আরও ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। বুধবার মারা যায় ৮৫ জন। সরকারি হিসাবে একদিনে আরও ৩২৩০ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৫৫৪টি ল্যাবে ৩০ হাজার ৩৫১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ৬৪ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৬টি নমুনা। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ, এই পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯১ দশমিক শূন্য ৫ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। ২৪ ঘণ্টায় যারা মারা গেছেন, তাদের ৫৫ জন পুরুষ আর নারী ২৬ জন।
এদিকে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ চিহ্নিত হয়েছে ও দেশে ইতোমধ্যেই রোগের প্রকোপ বেড়েছে। এই প্রজাতির ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে সারা দেশেই উচ্চ সংক্রমণ, পঞ্চাশের বেশি জেলায় অতি উচ্চ সংক্রমণ লক্ষ করা গেছে। রোগ প্রতিরোধের জন্য খ- খ-ভাবে নেয়া কর্মসূচির উপযোগিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এতে বলা হয়, অন্যান্য দেশ, বিশেষত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অভিজ্ঞতায় কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া এর বিস্তৃতি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। ভারতের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞের সঙ্গেও আলোচনা করা হয়েছে। তাদের মত অনুযায়ী, যেসব স্থানে পূর্ণ ‘শাটডাউন’ প্রয়োগ করা হয়েছে সেখানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ও জনগণের জীবনের ক্ষতি রোধের জন্য কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে সারা দেশে কমপক্ষে ১৪ দিন সম্পূর্ণ ‘শাটডাউন’ দেয়ার সুপারিশ করে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী করোনা টিকা সংগ্রহে সর্বাত্মক উদ্যোগ নিয়েছেন। এজন্য সভায় তাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।