স্টাফ রিপোর্টার: করোনাকালীন জীবন ও জীবিকার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হলেও কার্যত নতুন বাজেটটি গতানুগতিক বাজেট হচ্ছে। করোনার মধ্যে চলতি বছরের বাজেট বাস্তবায়নে ব্যর্থতার বিষয়টি আমলে না নিয়েই তৈরি করা হয়েছে আগামী বছরের বাজেট প্রস্তাব। যা আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হবে। ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে আজ জাতীয় সংসদে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের তৃতীয় বাজেট এটি। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালের এটি তৃতীয় বাজেট। দুপুর ৩টায় বাজেট বক্তৃতা শুরু করবেন তিনি। এবারের বাজেটে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে প্রাধিকার পাবে এমনটি উল্লেখ করেছে অর্থমন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম বাজেট ঘোষণা করেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৭২ সালের ৩০ জুন ঘোষণা করা সেই বাজেটের আকার ছিলো মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশের ৫০তম বাজেট নিয়ে আসছেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। যার আকার দাঁড়াচ্ছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের বাজেটের আকার বেড়েছে ৭৬৭ গুণ। এ পর্যন্ত সর্বমোট ৪৯টি বাজেট উত্থাপন করেছেন ১২ জন ব্যক্তি। তাদের মধ্যে একজন রাষ্ট্রপতি, ৯ জন অর্থমন্ত্রী ও দুজন অর্থ উপদেষ্টা। ব্যক্তি হিসেবে সবচেয়ে বেশি ১২টি করে বাজেট উত্থাপন করেছেন প্রয়াত এম সাইফুর রহমান এবং আবুল মাল আবদুল মুহিত। এর মধ্যে আবুল মাল আবদুল মুহিত আওয়ামী লীগের হয়ে রেকর্ড টানা ১০টি বাজেট উপস্থাপন করেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ৬ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার ব্যয় পরিকল্পনায় করোনার ক্ষতি মোকাবেলায় যে পরিমাণ আর্থিক বরাদ্দ এবং পদক্ষেপের প্রয়োজন ছিল তার যথাযথ প্রতিফলন থাকছে না। কর্মসংস্থান একটি বড় বিষয় হলেও সেটি কম গুরুত্ব পেয়েছে। বরং আগের মতোই প্রণোদনার ফিরিস্তি রয়েছে। যে প্রণোদনার নামে গোষ্ঠী বিশেষ ব্যবসায়ীকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হয়েছে। কর্মসংস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত ছিল গুরুত্বহীন। একইভাবে ক্রেতাস্বার্থ রক্ষায়ও কার্যকর পদক্ষেপের ঘোষণা থাকছে না। সূত্রমতে, শুধু উৎপাদকদের আর্থিক সহায়তা দিলে হবে না-বরং ক্রেতাদের হাতেও নগদ টাকার সংস্থান থাকতে হবে। ভোগব্যয় না বাড়ালেও ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপির প্রত্যাশাও পূরণ হবে না।
বিশ্বজুড়ে করোনাকালীন সময়ে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার হাতেই নগদ টাকা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ভোক্তাশ্রেণি রয়ে গেছে উপেক্ষিত। ফলে ব্যবসায়ীরাও বলছেন, পণ্য উত্পাদনে সহায়তা দিলেই হবে না। বরং ওই পণ্য কিনতে ক্রেতার হাতে পর্যাপ্ত অর্থ থাকতে হবে। সেই নিশ্চয়তা যদি না থাকে, তাহলে বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে শুরুতেই সংশয় অমূলক হবে না। অর্থনীতিবিদরাও বলেছেন, শুধু সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কথা বলে সংখ্যা বাড়িয়ে বা ভাতা বাড়িয়ে লাভ হবে না। বরং সামগ্রিক ভোগব্যয় বাড়াতে হবে। অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, ক্রেতার হাতে নগদ অর্থ সরবরাহ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও ভাবতে হবে। খাদ্য সহায়তা এবং আর্থিক সহায়তা-দুটো নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল জীবন-জীবিকার বাজেট হবে। এতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী তাদের উৎপাদনশীলতা দেখাতে সক্ষম হবে।
এসএমই ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলি জামান বলেন, জনসাধারণের ক্রয়-ক্ষমতা অস্বাভাবিক কমে গেছে। এ অবস্থায় যা শোনা যাচ্ছে তাতে পাইকারি খুচরা ব্যবসার ওপর আরোপিত ভ্যাটের চাপে ট্রেডিং খাত আরো বিপর্যস্ত হবে।
অর্থনীতিবিদ রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীরের মতে, ভাইরাসের প্রকোপের অনিশ্চয়তাকে আমলে না নেওয়ার কারণেই অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ১০ শতাংশ প্রণোদনাসহ অন্যান্য মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়েছে। এসব কার্যক্রমে রাজস্ব ও মুদ্রানীতি উভয়কে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতির কারণে ঘোষিত ঋণভিত্তিক প্রণোদনায় অধিকাংশ মানুষের কর্ম নিয়োজনকারী খাতগুলো বঞ্চিত থেকে গেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, স্বাস্থ্য খাতের বাজেটে এবারে বরাদ্দ বাড়ালেও ব্যয় সক্ষমতার প্রমাণ মেলেনি। নতুন বছরের বাজেটেও এখাতে বরাদ্দ বাড়ছে। স্বাস্থ্য খাতে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দের ঘোষণা আসতে পারে। তবে টিকার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার তাগিদ দিয়ে তারা বলেন, দ্রুততার সঙ্গে টিকা নিশ্চিত করে মানুষকে কর্মমুখী করতে পারাটাই হবে অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।
সূত্রমতে, প্রস্তাবিত বাজেটে প্রণোদনাসহ করোনা মোকাবেলায় নেয়া নানা পদক্ষেপের ফিরিস্তি উল্লেখ করা হচ্ছে। যদিও প্রণোদনার অর্থছাড় নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়ে গেছে। প্রণোদনা বা স্টিমুলাস প্যাকেজে শর্তের কারণেও অনেকে সুবিধা প্রাপ্তির যোগ্য হননি। এসব শর্ত দিয়ে বরং গোষ্ঠীবিশেষকেই সুবিধা দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগও উঠেছে। প্যাকেজের টাকা নিয়ে বরং ব্যাংকগুলো নিজেদের আর্থিক অবস্থান সুসংহত করেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও টাকা পাননি। এতে আটকে গেছে ব্যাংকের অর্থায়নকৃত প্রকল্পও। জ্বালানি সংকট, ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা সমস্যা তো রয়েছেই। উদ্যোক্তারা বলছেন, এখনকার সংকটে থাকা শিল্পকারখানাগুলো কিংবা স্থবির ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতিতে নতুন বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য রয়েছে তা বাস্তবায়ন হবে কীভাবে? অর্থনীতিবিদদের মতে, ভ্যাট-ট্যাক্স যেখান থেকে আদায় হয়, সেই ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা সংকটাপন্ন। তাহলে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হবে কীভাবে—সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
পূর্ববর্তী পোস্ট
চুয়াডাঙ্গার সংক্রমিত এলাকায় স্বাস্থ্য বিভাগের র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় ২৪ জন করোনা শনাক্ত
পরবর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ