করোনায় অর্থনৈতিক কর্মকা- সচলে বিকল্প চিন্তা : শুধু সংক্রমণ এলাকায় লকডাউনের পরামর্শ
স্টাফ রিপোর্টার: অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল রাখার স্বার্থে সারা দেশে একযোগে লকডাউন না-দিয়ে সংক্রমণের মাত্রাভেদে অঞ্চল বা এলাকাভিত্তিক দেয়ার প্রস্তাব করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, করোনার সংক্রমণ রোধে সারা দেশে একসঙ্গে লকডাউন দিলে অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির হয়ে যায়। থমকে যায় ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি। কমে যায় টাকার প্রবাহ। এতে মানুষের আয়ও কমে। স্বল্প আয়ের মানুষ বড় বিপাকে পড়ে। এসব ভোগান্তি এড়িয়ে করোনার মধ্যেও অর্থনীতিকে সচল রাখতে এই বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন তারা। করোনার ভয়াল থাবায় গত বছর বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে সাড়ে ৪ শতাংশ নেতিবাচক হয়েছে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিও কমেছে। বিশ্বের অনেক দেশে এখন চলছে করোনার তৃতীয় ঢেউ। বাংলাদেশে চলছে দ্বিতীয় ঢেউ। প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ের থাবা আরও ভয়াবহ।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, করোনার সংক্রমণ শিগগির থামবে না। এটি চলমান থাকবে। সে কারণে এর সংক্রমণ বিবেচনায় নিয়েই অর্থনীতিকে সচল রাখতে হবে। চালাতে হবে ব্যবসা-বাণিজ্য। নির্বাহ করতে হবে মানুষের জীবন-জীবিকা। এর আলোকে সরকারকে নীতিনির্ধারণ করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকারের সামনে রয়েছে ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জ। একদিকে করোনার সংক্রমণের বিস্তার ঠেকানো, অন্যদিকে অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল রাখা। তৃতীয়ত, বৈদেশিক বাণিজ্য আরও বাড়ানো। তাহলেই অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যাবে।
প্রথম ঢেউয়ের মধ্যেই অনেক দেশ করোনা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ধরনের কৌশল উদ্ভাবন করেছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউয়ে সেগুলোর প্রয়োগে সুফল পেয়েছে। এর মধ্যে চীন প্রথম ঢেউয়ের পর দ্বিতীয় ঢেউ আসতেই দেয়নি। জার্মানি, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য তৃতীয় ঢেউ মোকাবেলা করছে। মালয়েশিয়া দ্বিতীয় ঢেউ সফলভাবে মোকাবেলা করছে। ভারতে করোনা ভয়াবহ রূপ নিলেও পুরো দেশে লকডাউন দেয়া হয়নি। সীমিত আকারে রাজ্যভেদে লকডাউন দেয়া হয়েছে।
এসব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশেও করোনার বিস্তার রোধ করে অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল রাখার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব এসেছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও অর্থনৈতিক কর্মকা- নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোও একই ধরনের অভিমত দিয়েছেন।
তারা বলেছেন, করোনা আছে, থাকবে। এটি রেখেই অর্থনৈতিক কর্মকা- এগিয়ে নিতে হবে। এজন্য এখন থেকে আর সারা দেশে একসঙ্গে লকডাউন নয়। যেখানে সংক্রমণ সেখানেই লকডাউন। সংক্রমণের বাইরে দেশের অন্যান্য স্থানে অর্থনৈতিক কর্মকা- স্বাভাবিক রাখতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে হবে। বাড়াতে হবে সচেতনতা।
ওইসব দেশের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান করোনার মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল রাখতে যেখানে সংক্রমণ সেখানে লকডাউন করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এজন্য তিনি একটি ‘স্মার্ট লকডাউন’ নীতিমালা তৈরি করেছেন, যা গত ১২ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ করেছেন।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান স্বাস্থ্য অধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন সংগঠন ও পেশাজীবীদের জোট হেলদি বাংলাদেশের আহ্বায়কও। তিনি বলেন, কোথায় করোনার সংক্রমণ কতটুকু, সে তথ্য সরকারের কাছে রয়েছে। সে অনুযায়ী সংক্রমণ রোধে অঞ্চল বা এলাকাভেদে লাকডাউন আরোপ করা যেতে পারে। এর মধ্যে করোনা ছড়ায় এমন সব কর্মকা- বন্ধ রেখে বাকি সব সীমিত আকারে চালু রাখার প্রস্তাব করেছেন তিনি। একইসঙ্গে মানুষের যাতে ভিড় না-হয়, সেজন্য বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্যই তিনি স্মার্ট লকডাউনের প্রস্তাব করেছেন।
স্মার্ট লকডাউনের নীতিমালার আওতায় সংক্রমণপ্রবণ এলাকায় আন্তঃজেলা গণপরিবহণে বন্ধ রেখে শ্রমিকদের বিকল্প সহায়তা করতে হবে। মার্কেট বা শপিংমল একেবারে বন্ধ না-রেখে দিনের নির্দিষ্ট সময় খোলা রেখে ভিড় যাতে না-হয়, সে বিষয়টি মার্কেট কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। সংক্রমণ এলাকার বিনোদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা যেতে পারে। যেসব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বাসায় বসে কাজের সুযোগ রয়েছে, সেগুলোয় ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বা বাসায় বসে কাজ করার নীতি চালু করতে হবে।
নীতিমালায় বলা হয়, করোনা সংক্রমণের হটস্পট, সাময়িক হটস্পট, সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ হটস্পট এভাবে সারা দেশকে চিহ্নিত করে ঝুঁকি বিবেচনায় ব্যবস্থা নিতে হবে।
এদিকে করোনার মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল রাখতে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সম্প্রতি এক বৈঠকে সারা দেশে একসঙ্গে না দিয়ে সংক্রমিত এলাকায় লকডাউন দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। একসঙ্গে লকডাউন দিলে সংক্রমিত নয়, এমন এলাকায়ও অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির হয়ে যাচ্ছে। এতে মানুষের ক্ষতি হচ্ছে। এ কারণে শুধু সংক্রমিত এলাকায় লকডাউন দিলে ওই এলাকা থেকে যেমন ছড়ানোর সুযোগ কমবে, তেমনি সংক্রমিত নয় এমন এলাকাগুলো কার্যক্রম চালু রাখা যাবে। এতে অর্থনীতি সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তবে স্থবির হবে না।
এ প্রসঙ্গে পল্লি কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুর কাদের বলেন, সারা দেশে স্বল্প আয়ের অনেক মানুষ আছে যারা দিন আয়ে চলে। কোনো সঞ্চয় নেই। তাদের কর্মকা- চালানোর সুযোগ দিতে হবে। এ কারণে স্মার্ট লকডাউনের প্রস্তাবটি যুক্তিসংগত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগের ১৫ জনের বেশি করোনায় আক্রান্ত হলেও বিভাগটি বন্ধ করা হয়নি। জীবাণুমুক্ত করে সীমিত আকারে চালু রাখা হয়েছে। এখন এ নীতিতে চলবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রেও এ নীতি চালু করা হয়েছে। ফলে এখন আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ শাখায় করোনার সংক্রমণ দেখা গেলেও তা পুরো বন্ধ হবে না। সীমিত আকারে খোলা থাকবে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে অর্থনৈতিক কর্মকা-ের বিকাশ এমনভাবে ঘটেছে যে, আর্থিক সেবা বন্ধ রাখার সুযোগ নেই। জনগণের টাকা তোলার সুযোগ সবসময় দিতে হবে। তা না-হলে ব্যাংকব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে। এছাড়া শিল্পকারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে ব্যাংক খোলা না-রেখে কোনো বিকল্প নেই। কারণ, এসব প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকা- ব্যাংক নির্ভর। এ ছাড়া রপ্তানি, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক দায়-দেনা পরিশোধ-সবই ব্যাংক নির্ভর।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) চেয়ারম্যান আবুল কাসেম খান বলেন, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে পুরো লকডাউন দিয়ে এখন আর ক্ষতি পোষানো যাবে না। কেননা, এখন কোনো দেশই পুরো লকডাউন দিচ্ছে না। অঞ্চলভেদে লকডাউন দিচ্ছে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য আংশিক খোলা থাকছে। এ কারণে বাংলাদেশেও পুরো লকডাউন দিলে ব্যবসা-বাণিজ্য ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। রপ্তানিতে ধস নামবে। বাজার ধরে রাখার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, গত বছর যে ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে আবার দ্বিতীয় ধাক্কা। ফলে গত বছরের ও বিদেশি অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যও চালাতে হবে।
সূত্র জানায়, গত ৫ এপ্রিল থেকে চলছে টানা বিধিনিষেধ। শেষ হওয়ার কথা ২৮ এপ্রিল। এরপর আংশিক শিথিল করার কথা। বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাজশাহী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ বেশকিছু এলাকায় করোনার ঝুঁকি বেশি। কিন্তু অনেক অঞ্চল রয়েছে যেগুলোয় করোনার প্রকোপ নেই। ফলে ওইসব এলাকাও লকডাউনের আওতায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকা- যত বেশি বাড়বে, তত দ্রুত টাকার হাতবদল হবে। টাকার হাতবদল বেশি হওয়া মানেই অর্থনৈতিক কর্মকা- বাড়ছে। এতে যারা অর্থনৈতিক কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত তাদের হাতেই টাকার প্রবাহ কিছু কিছু যাচ্ছে। যা দিয়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করছে। বাড়তি অর্থ সঞ্চয় বা বিনোদনে ব্যয় করছে। কিন্তু লকডাউনে অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির থাকলে টাকার হাতবদল কমে যায়। তখন অর্থনৈতিক কর্মকা-ে সব মানুষের যুক্ত হওয়ার সুযোগ কমে যায়। ফলে একটি শ্রেণির হাতে টাকা যায় না। তাদের জীবিকা সংকটে পড়ে।
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ