মাথাভাঙ্গা ডেস্ক: চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা, জীবননগর ও ঝিনাইদহের মহেশপুরে প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে চড়ক মেলা। প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব এটি। এতে বাঁশ, বেত, প্লাস্টিক, মাটি ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র ও খেলনাসহ বিভিন্ন ধরনের ফল-ফলাদি বেচা-কেনা হয়। কিন্তু করোনা এবারও আঘাত হেনেছে চৈত্র সংক্রান্তির সেই মেলায়। করোনা সংক্রমণ রোধে ঐতিহ্যবাহী চড়ক মেলা এবার হচ্ছে না। কারণ এক জায়গায় বেশি লোকের জমায়েত বা ভিড় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রশাসনের পরামর্শ মেনেই লকডাউন শুরুর পরই মেলা কমিটি মেলা না করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে পরিস্থিতির কারণে মেলা বন্ধ রেখে স্বল্প পরিসরে শুধুমাত্র পূজার আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হচ্ছে।
আলমডাঙ্গা ব্যুরো জানিয়েছে, হাজারও মানুষ অপলক তাকিয়ে ৩০ ফুট উচ্চতার কাঠের দ-ের দিকে। দুজন মানুষ শূন্যে ঘুরছে একটি বাঁশের দুই মাথার রশিতে ঝুলে। দড়িটি বাঁধা ওই মানুষগুলোর পিঠের চামড়ার সঙ্গে গাঁথা বড় দুটি বড়শির সঙ্গে। চলছে উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি। বাজছে ঢাকঢোল। বড়শিতে ঝুলে থাকা ২ জন তাঁদের সঙ্গে থাকা ফুল-জল, আবির, বাতাসা, নকুলদানা, আম ইত্যাদি ছিটিয়ে দিচ্ছেন অগণিত ভক্ত-দর্শকের দিকে। আলমডাঙ্গা শহরের ঘোষপাড়ার বিষুয়া বাবু মাঠ প্রাঙ্গণে এ দৃশ্য দেখছে সবাই। দীর্ঘদিন ধরে আলমডাঙ্গা শ্রী শ্রী গাংবাড়ী কালী মন্দির প্রাঙ্গণে এ উৎসব হচ্ছে। পুরোনোকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করতে বরাবরের মতো এবারও ৫ দিনের মেলার আয়োজন করে। কিন্তু এ বছর করোনা পরিস্থিতি ও লকডাউনের কারণে পাল্টে গেছে উৎসবের চিত্র। মেলা বন্ধ রেখে স্বল্প পরিসরে পূজার আয়োজন করা হয়েছে। ১৩ এপ্রিল সেখানে কয়েক হাজার ভক্ত-দর্শনার্থী সমবেত হন।
চড়ক পূজার উৎসবে আসা ডা. অমল কুমার বিশ^াস ও বিশ^জিৎ সাধুখাঁ বলেন, প্রায় সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই চড়ক উৎসবের আয়োজন শুরু হয়। ধর্মানুরাগী ‘সন্ন্যাসীরা’ বাড়ি বাড়ি গিয়ে নৃত্যগীতের মাধ্যমে চড়ক পূজার জন্য চাল ও অর্থ সংগ্রহ করেন। এ দিনগুলোতে তাঁরা সন্যাসব্রত ও উপবাস পালন করেন। এ সময় স্থানীয় শ্মশানগুলোয় হিন্দুধর্মাবলম্বীরা নানা পূজা অর্চনা করে থাকেন।
উৎসব আয়োজক কমিটির সদস্য চঞ্চল ঘোষ বলেন, কয়েক বছর আগে থেকে এ পূজা চলে আসছে। প্রতিবছরের পূজা শেষে শিবমন্দিরের দিঘিতে ডুবিয়ে রাখা চড়কগাছকে নতুন পূজার সময় তুলে আনা হয়। মাঠের মাঝখানে গর্ত করে খাড়া করে বসানো হয় এ চড়কগাছ।
শ্রী শ্রী চড়ক পূজা উৎযাপন কমিটির সভাপতি বিষু ঘোষ বলেন, আমরা প্রশাসনের সহযোগিতায় সুষ্ঠুভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বল্প পরিসরে পূজার আনুষ্ঠানিকতা পরিচালনা করছি। স্বেচ্ছাসেবক টিম সব সময় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক বিতরণ নিশ্চিত করছে। ইতিপূর্বের পূজার সাথে মেলাও হতো। কিন্তু করোনার কারণে আমরা এবার মেলা বন্ধ রেখেছি। এ কারণে কোনো দোকানপাট বসতে দেয়া হয়নি।
আয়োজক সূত্র জানায়, বড়শিতে বিদ্ধ মানুষগুলোকে ঘোরানোর আগে সারা দিন ধরে নানা আচার পালন করা হয়। এর মধ্যে ‘পাটারভাঙা’ খুব জনপ্রিয়। বাঁশ দিয়ে বানানো উঁচু একটি ‘তাড়া’ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েন ‘সন্ন্যাসীরা’। মানুষ ঘূর্ণনের জন্য পোঁতা কাঠের দ-টি মাঠের মাঝখানে বসানো। অনেকটা লাঙলের জোয়ালের মতো আরেকটি কাঠ এই কাঠের ওপর লম্বালম্বিভাবে বসানো। কাঠের মাথায় থাকে মাটি পর্যন্ত ঝোলানো কয়েকটি লম্বা দড়ি। কাঠের দ-ের ঠিক নিচে একদল মানুষ শক্ত হাত দিয়ে ঘোরান দড়িগুলো। এটাই চড়ক পূজার মূল আকর্ষণ। শ্রী শ্রী চড়ক পূজা উৎযাপন কমিটির সকল সন্ন্যাসীবৃন্দ মহামারী করোনায় মধ্যেও তারা সকলকে সামাজিক দূরত্ব ও মাস্ক পরিধানের মাধ্যমে চড়কপূজার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন।
জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছে, চৈত্র মাসের শেষ দিনটি যেমন মাসের শেষ দিন, তেমনি বছরেরও শেষ দিন। সাধারণভাবে বাংলা মাসের শেষ দিনটিকে বলা হয় সংক্রান্তি। বর্ষ শেষের এই দিনটি ‘চৈত্র সংক্রান্তি’ নামে পরিচিত। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে জীবননগর উপজেলার উথলী গ্রামের মাঝের পাড়ায় প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে চড়ক মেলা। প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব এটি। এতে বাঁশ, বেত, প¬াস্টিক, মাটি ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র ও খেলনাসহ বিভিন্ন ধরনের ফল-ফলাদি বেচা-কেনা হয়। কিন্তু করোনা এবারও আঘাত হেনেছে চৈত্র সংক্রান্তির সেই মেলায়। করোনা সংক্রমণ রোধে উথলী গ্রামের ৩শ’ বছরের সেই ঐতিহ্যবাহী চড়ক মেলা এবার আর হলো না। কারণ এক জায়গায় বেশি লোকের জমায়েত বা ভিড় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রশাসনের পরামর্শ মেনেই লকডাউন শুরুর পরই মেলা কমিটি মেলা না করার সিদ্ধান্ত নেয়। মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য শ্রী সরজিত কুমার কর্মকার বলেন, চৈত্র মাসের শেষ দিনে সংক্রান্তি উপলক্ষে মেলায় বিভিন্ন জায়গার মানুষ এসে ভিড় করে। করোনা সতর্কতার জন্যই এ বছর সংক্রান্তিতে মেলা বন্ধ করা হয়েছে।মেলা কমিটির সদস্য সুনিল কর্মকার বলেন, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মাঝে চারপাশে শুধু বেদনার প্রতিচ্ছবি। বুকে করোনার ক্ষত নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার শেষ হয়েছে ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। গতকাল ছিলো চৈত্র সংক্রান্তি। গতকালের সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে পুরোনো বছর। করোনার কারণে ৩শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী মেলা এবার আর হলো না। ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মঈনুল হাসান জানান, আবহমান বাংলার চিরায়ত নানা ঐতিহ্যকে ধারণ করে আসছে এই চৈত্র সংক্রান্তি। বছরের শেষ দিন হিসেবে পুরাতনকে বিদায় ও নতুন বর্ষকে বরণ করার জন্য প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে এখানে থাকে নানা অনুষ্ঠান উৎসবের আয়োজন। প্রতি বছর নাচ, গান, আনন্দ-উল¬াসসহ নানা আয়োজনে চৈত্র সংক্রান্তির মধ্য দিয়ে পুরোনো বছরকে বিদায় জানালেও বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে গত বছরের মতো এবারও চৈত্র সংক্রান্তিতে ছিলো না কোনো কার্যক্রম।
মহেশপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, মহামারী করোনার ভাইরাসের কারণে মহেশপুরের ফতেপুর বকুলতলা বাজারে ঐতিহ্যবাহী চড়কপূজার মেলা এবারও হচ্ছে না। মেলার সভাপতি শ্রী সাধন কুমার ঘোষ জানান, করোনার কারণে এবারও চড়কপূজার মেলা হচ্ছে না। গত বছরেও মার্চ মাসে লকডাউন শুরু হওয়ায় মেলা করা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা এই উৎসব দীর্ঘদিন ধরে পালন করে এসেছেন। আমরাও উৎসবটি আনন্দের সাথে পালন করে থাকি। পহেলা বৈশাখ থেকে মেলা শুরু হয়ে চলতো তিনদিন ধরে। মেলার প্রধান আর্কষণ শেষ দিন ৩ বৈশাখ চড়কপূজা। এদিন হিন্দু ধর্মীয় কিছু লোক সন্যাসী সেজে পিঠে লোহার বরসি ফুঁটিয়ে চড়ক গাছে তুলে রসির সাথে বেঁধে ঘুরানো হয়। এবারও ৬/৭ জন সন্যাসী ছিল যাদেরকে পিঠে বড়সি ফুঁটিয়ে চড়ক গাছে তুলে ঘুরানো হতো। কিন্তু মেলা না হওয়ার কারণে তা আর হলো না, তবে পূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হবে। হিন্দুধর্মালম্বী প্রবীণ ব্যক্তিরা মনে করেন, ৪/৫শ বছর পূর্ব থেকে এই পূজা চলে আসছে। মেলা না হওয়ায় ইতিহাসের ছন্দপতন ঘটলো। ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম সিরাজ বলেন, সরকার ঘোষিত লকডাউন এবং নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে চড়ক পূজার মেলা হচ্ছে না। তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের এ ব্যাপারে প্রস্তুতি ছিল।
পূর্ববর্তী পোস্ট
পরবর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ