সদ্য প্রয়াত মকবুলার রহমানকে নিয়ে একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখা
.......... রাজীব আহমেদ ..............
৫০ বছর আগেই পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করার কথা ছিল তাঁর- ফায়ারিং স্কোয়াড-এ মৃত্যুর তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১; সেই মানুষটি গত ২১ জানুয়ারি ২০২১ তারিখ সন্ধ্যায় চিরবিদায় নিলেন!
বলছি বহু গুণে গুণান্বিত সাহিত্য অনুরাগী, সমাজ সেবক ও চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবন্ত কিংবদন্তি মকবুলার রহমানের কথা- যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও শান্তি নিকেতন থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করার পর পিতৃভূমিতে ফিরে এসে মুন্সীগঞ্জ একাডেমীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
জেহালা ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছাড়াও তৎকালীন চুয়াডাঙ্গা মহকুমার ইউনিয়ন কাউন্সিলগুলোর মুখপত্র ‘পাক্ষিক গ্রাম’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাঁকে সভাপতি করেই যাত্রা শুরু হয়েছিল চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের। ১৯৬৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সভাপতি হয়ে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত টানা সাত বছর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালের ২০ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদ-এরও তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
সাহিত্যসেবী ও পণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে মকবুলার রহমানের পরিচিতি সুবিদিত; ছিলেন আলমডাঙ্গা উপজেলার প্রথম নির্বাচিত (সর্বসম্মতিক্রমে) চেয়ারম্যান। তাঁর ব্যক্তিগত পাঠাগারটি অনেক মূল্যবান ও দুর্লভ বইয়ে ভরপুর। চুয়াডাঙ্গার আবুল হোসেন স্মৃতি পাঠাগারে সংরক্ষিত এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সেটটি তাঁরই দানকৃত। তাঁর মতো বিদ্যোৎসাহী মানুষ বর্তমান সময়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর!
ডা. মকছেদ আলীর ছেলে মকবুলার রহমানের জন্ম ১৯২৬ সালে (১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ১ আষাঢ়) নাগদহ গ্রামে। সেই হিসেবে মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। বাংলাদেশের গড় আয়ু যেখানে ৭০-এর আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে, সেখানে প্রায় মকবুলার রহমানের দীর্ঘায়ু লাভ কৌতূহলোদ্দীপকও বটে।
জীবনের শেষ পর্যন্ত তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল টনটনে, দৃষ্টিশক্তি প্রখর আর শ্রবণশক্তি ছিল যথার্থ; অনেকগুলো দাঁতও অক্ষত ছিল মুখ-গহ্বরে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত একাকী চলাফেরা করতেন, সকালের দিকে বাড়ির বাইরে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে যে কারো সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিতেন। পত্রিকা এলে চোখ বুলিয়ে নিতেন। কথা বলতেন শান্তি নিকেতনি ভাষায়, প্রমিত বাংলায়।
মুক্তিযুদ্ধকালীন দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের প্রধান উপদেষ্টা ডা. আসহাব-উল হক ছিলেন মকবুলার রহমানের নিকটাত্মীয়। সেই সুবাদে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নে মকবুলার রহমান স্বাধীনতার সপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতারা সবাই আত্মগোপন করে ভারতে আশ্রয় নিলেও মকবুলার রহমান নিজ এলাকায় থেকে যান এবং পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নির্যাতিত হন। তাঁকে বন্দি করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। সপরিবারে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার রাজকীয় বন্দোবস্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি তা গ্রহণ করেননি!
শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার নিকটাত্মীয় (ফুপাতো ভাই ও ভগ্নিপতি) হিসেবে তাঁর বেঁচে থাকার কথা নয়। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রমাণপত্রও পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে পৌঁছে যায়। অভিযোগ ‘সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত’ হওয়ায় সামরিক আদালত তাঁকে ফায়ারিং স্কোয়াড-এ মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে। রায় কার্যকর করার দিণক্ষণ নির্ধারিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর। কিন্তু সে রায় বাস্তবায়নের আগেই মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের ইঙ্গিত স্পষ্ট হওয়ায় নিতান্ত সৌভাগ্যক্রমে মৃত্যুর দুয়ার থেকে বেঁচে ফিরে আসেন তিনি। দেশ স্বাধীনের পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। সে কারণে নিজেই রসিকতা করে বলতেন, ৫০ বছর ধরে ‘এক্সটেনশন লাইফ’-এ আছি!
বছরখানের আগে সর্বশেষ সাক্ষাতে মকবুলার রহমানের কাছেই জানতে চেয়েছিলাম তাঁর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ জীবনের রহস্য। তিনি বলেছিলেন, জীবনভর পরিমিত খাবার খেতেই অভ্যস্থ তিনি। মাংস কদাচিৎ খান, তবে ছোট মাছ বরাবরই তাঁর প্রিয় খাদ্যের তালিকায় রয়েছে। চিনি খাওয়া বাদ দিয়েছেন যৌবনেই, শরীরে কোনো রোগ বাসা বাঁধার আগেই। একদা জর্দাসহ পান আর ধূমপানে অভ্যস্থ ছিলেন বলে একমাত্র শ্বাসকষ্ট তাঁকে খনিকটা কাবু করে রেখেছে। অন্যথায় বিশেষ কোনো শারীরিক সমস্যা নেই। সারাজীবন টেনশন কম করেছেন, জীবনে খুব বেশি প্রত্যাশা করেননি তাই অপ্রাপ্তির অনুশোচনাও নেই। যা কিছু চেয়েছেন, এক জীবনে পেয়েছেন তার চেয়ে বেশি বৈকি কম নয়!
আমি মকবুলার রহমনের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
ওনাকে দেখার সৌভাগ্য একবার হুয়েছিল । তিনি স্বর্গ বাসি হন।