চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মকবুলার রহমানের ইন্তেকাল : আজ দাফন
জেলার প্রবীণ ব্যক্তিত্ব সাবেক আলমডাঙ্গা উপজেলা চেয়ারম্যান জ্ঞানতাপসের চিরবিদায়
স্টাফ রিপোর্টার: বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আলমডাঙ্গা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জেহালার কৃতি ব্যক্তিত্ব মকবুলার রহমান আর নেই (ইন্নালিল্লাহে………..রাজেউন)। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টায় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই জ্ঞানতাপস। তার মৃত্যুর খবর শোনার সাথে সাথে চুয়াডাঙ্গাসহ আশপাশ এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। আজ শুক্রবার বাদজুম্মা আলমডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জে তার দাফন সম্পন্ন হবে। তার মৃত্যুতে বিভিন্ন মহল থেকে শোক জানানো হয়েছে।
পারিবারিকসূত্রে জানা গেছে, মকবুলার রহমান বেশ কয়েক মাস ধরে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। এরই মধ্যে বুধবার তাকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টায় মারা যান তিনি। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী উম্মে আতিয়া বানু, এক ছেলে, চার মেয়ে, নাতি নাতকুরসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। মকবুলার রহমান অসংখ্য গুণের অধিকারী ছিলেন। তার চলাফেরা ও কথাবার্তায় ছিলো আলাদা ঢং। তিনি ছিলেন জেলার একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। মকবুলার রহমান যখন কোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতেন দর্শক-শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতেন। এলাকার মানুষ তাকে মকবুল মিয়া নামেই চিনতেন। চুয়াডাঙ্গা জেলায় ইতঃপূর্বে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন মোহাম্মদ আবদুল মাননান। মকবুলার রহমানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে তিনি মাথাভাঙ্গাকে বলেছেন ‘চুয়াডাঙ্গার মানুষ একজন বিরল প্রতিভাধর ও একজন গুণী মানুষকে হারালো। আমি ব্যক্তিগতভাবে ওনাকে খুব সম্মান করতাম। এ কারণে আমি আমার লেখা একটি গল্পের বই ‘সব চরিত্রই কাল্পনিক’ তাকে উৎসর্গ করেছি। আমি তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।’ নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদ থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া চুয়াডাঙ্গার সাবেক জেলা প্রশাসক ভোলানাথ দে বলেছেন, ‘আহা রে, আমি খুবই মর্মাহত। আমার জীবনে এমন গুণী মানুষ আর দেখিনি। আমার চাকরি জীবনে চুয়াডাঙ্গার যতো মানুষকে দেখেছি, যতো মানুষের কথা শুনেছি তার মধ্যে প্রবীণ ব্যক্তিত্ব মকবুলার রহমান চিরস্মরণীয়। তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে খুব কষ্ট পাচ্ছি। আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করি।’ চুয়াডাঙ্গার আরেক সাবেক জেলা প্রশাসক সায়মা ইউনুস বলেছেন, ‘মুরব্বি খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। তার মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত। আমি তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।’
মকবুলার রহমানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সভাপতি সরদার আল আমিন, সাধারণ সম্পাদক রাজীব হাসান কচি, চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মাহাতাব উদ্দীন, দৈনিক মাথাভাঙ্গার বার্তা সম্পাদক আহাদ আলী মোল্লা, চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হামিদুল হক মুন্সী, কেন্দ্রীয় বিএনপির নেতা ও দেশরক্ষা আন্দোলনের চেয়ারম্যান এম সানোয়ার হোসেন, জেহালা ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুল হক রোকন, মুন্সিগঞ্জ একাডেমির প্রধান শিক্ষক আতিয়ার রহমান ও মুন্সিগঞ্জ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শঙ্কর পাত্র। তারা মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। মকবুলার রহমানের ছেলে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান পুলক জানান, শুক্রবার বাদজুম্মা মুন্সিগঞ্জ ফুটবল মাঠে তার পিতার জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। পরে পার্শ্ববর্তী কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হবে। তার পিতার জানাজায় শুভাকাক্সক্ষীসহ আত্মীয়-স্বজন ও ধর্মপ্রাণ মুসলামানদের অংশগ্রহণের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন পুলক।
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার জেহালা বাজারের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব প্রয়াত ডা. মকছুদ আলীর একমাত্র ছেলে মকবুলার রহমান ১৯২৬ সালের ১৫ জুন এবং বঙ্গাব্দ ১৩৩৩ সনের ১ আষাঢ় আলমডাঙ্গা উপজেলার নাগদাহ গ্রামে নিজ বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ডা. মকছুদ আলী, মাতার নাম মালেকা খাতুন আর দাদার নাম মোজাফফার হোসেন। তার নানাবাড়ি যশোর বেলতলায়। নানার নাম ওয়াজির আলী। মকবলুার রহমান মাত্র চার বছর বয়সে ১৯৩০ সালে নাগদাহ গ্রাম থেকে সপরিবারে জেহালা বাজারে চলে আসেন। তারা ছিলেন তিন বোন আর এক ভাই। মকবুলার রহমান যশোর জোড়াদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সময় ১৯৪০ সালে মুন্সিগঞ্জে চলে আসেন এবং মুন্সিগঞ্জ বেণী মাধব হাইস্কুলে (মুন্সিগঞ্জ একাডেমী) ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৪৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে এক বছর বিরতি দিয়ে ১৯৪৪ সালে ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান মাওলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হন। ওই বছরই শান্তি নিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে আইএসসি পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত মকবুলার রহমান এখানে লেখাপড়া করেন। পরে ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে রাজশাহী সরকারি কলেজে (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। কিন্তু এখানে মুসলিম ও হিন্দু ছাত্রদের মধ্যে বিরোধ থাকায় সেখানে তিনি পড়াশোনা না করে ফিরে গেলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তার সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক ড. আশরাফ সিদ্দিকী। এছাড়া তিনি বিখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী, অমিতাভ চৌধুরীর সাহচার্য লাভ করেন। এ সময় তিনি শিক্ষক হিসেবে পান বিশ্ববতী চৌধুরী ও ড. শ্রী কুমার ব্যানার্জিকে। ১৯৫০ সালে মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের আগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে কোলকাতা থেকে মকবুলার রহমান আলমডাঙ্গার নিজবাড়ি মুন্সিগঞ্জে ফিরে আসেন। ফলে চূড়ান্ত পরীক্ষা দেয়া হয় না তার। ১৯৫০ সালের ওই সময় চুয়াডাঙ্গা মহকুমার এসডিও ছিলেন এমএকে বেগ। তার বিশেষ অনুরোধে বর্তমান মুন্সিগঞ্জ একাডেমির প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন। ১৯৫৬ সালের ১৪ আগস্ট ৭২ বছর বয়সে মারা যান মকবুলার রহমানের পিতা ডা. মকছুদ আলী। এ কারণে ওই বছর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন তিনি।
১৯৮৫ সালে প্রথম আলমডাঙ্গা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মকবুলার রহমান। ১৯৬৬ সালে চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন মকবুলার রহমান। ১৯৭৭ সালের ২০ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়। চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন তিনি। মকবুলার রহমান ছিলেন জেহালা ইউনিয়নের এক সময়ের প্রেসিডেন্টও।