স্টাফ রিপোর্টার: করোনা থেকে সুরক্ষায় দেশের মানুষ নানা ধরনের প্লাস্টিক পণ্যে ঝুঁকছে। বিশেষ করে একবার ব্যবহারযোগ্য (ওয়ান টাইম) থালা-গ্লাসসহ নানা সামগ্রী ব্যবহার করেছে। এছাড়া ব্যবহার বেড়েছে সার্জিক্যাল মাস্ক, প্লাস্টিকের তৈরি ফেস শিল্ড, হ্যান্ড গ্লাভস ও পলিথিন ব্যাগের। হোটেল-রেস্তোরাঁ ও বাসা-বাড়িতে নিম্নমানের এসব পণ্য ব্যবহারের কারণে খাদ্যচক্রের সঙ্গে মিশে প্রতিদিনই মানুষের পেটে যাচ্ছে প্লাস্টিক কণা। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলো রক্তের মাধ্যমে মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে ক্যানসারসহ নানা ধরনের মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (ডব্লিউডব্লিউএফ) ইন্টারন্যাশনালের গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে প্লাস্টিকসংক্রান্ত দূষণ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতি সপ্তাহে একজন প্রায় ৫ গ্রাম বা একটি এটিএম কার্ডের সমপরিমাণ প্লাস্টিক কণা নিজের অজান্তেই খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করছে। সংস্থাটি তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, প্রতিবছর বিশ্বে ৩৮১ মিলিয়ন মেট্রিক টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য হয়। এর মধ্যে পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৫৭, ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় ৪৫ এবং উত্তর আমেরিকায় ৩৫ মিলিয়ন টন উৎপন্ন হয়। এ বর্জ্যরে ৫০ শতাংশই একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্য থেকে তৈরি হচ্ছে। গত বছর এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়েছে।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অণুপ্রাণবিদ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিনের পরিচালক অধ্যাপক ডা. একেএম শামছুজ্জামান বলেন, প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা মূলত ‘মাইক্রো মলিকিউল’। মেলামাইন এবং প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহার করলে এসব কণা শরীরে প্রবেশ করে। শরীরে প্রবেশের পর এগুলো অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকে। রক্তের মাধ্যমে এগুলো শরীরের বিভিন্ন কোষে ঢুকে পড়ে এবং কোষগুলোকে নষ্ট করে দেয়। এভাবে কোষের মৃত্যু হয়। মানবদেহের কোনো অঙ্গের কোষ এভাবে নষ্ট হতে থাকলে সেই অঙ্গ ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে পড়ে। এতে নানা ধরনের জটিল রোগ, এমনকি ক্যানসারও হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাকালে বাসা-বাড়ি থেকে শুরু করে হোটেল-রেস্টুরেন্ট বা চায়ের দোকানে প্লাস্টিকের কাপ গরম চা পরিবেশনে ব্যবহার হচ্ছে। এতে প্লাস্টিক স্বল্প পরিমাণে গলে চায়ের মধ্যে মিশে মানুষের দেহে প্রবেশ করছে। পাশাপাশি, খাবার পানি, সাধারণ খাবার, সামুদ্রিক মাছ এবং যত্রতত্র ব্যবহার্য প্লাস্টিকের কণা মানবদেহে যাচ্ছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) এ সংক্রান্ত এক জরিপ পরিচালনা করে। সেখানে দেখা যায়, গত বছর শুধু মে মাসে করোনা শুরুর পর এক মাসে ১৪ হাজার ১৬৫ টন একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে।
এর মধ্যে ৩ হাজার ৭৬ টন উৎপন্ন হয় ঢাকায়। এসব বর্জ্যরে প্রায় ১২ দশমিক ৭ শতাংশ সার্জিক্যাল ফেস মাস্ক, ২৪ দশমিক ২ শতাংশ পলিথিনের তৈরি সাধারণ হ্যান্ড গ্লাভস, ২২ দশমিক ৬ শতাংশ সার্জিক্যাল হ্যান্ড গ্লাভস এবং ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ খাদ্যদ্রব্য বহনের একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিনের ব্যাগ। বেসরকারি এই সংস্থাটি বলছে, এ বর্জ্যরে কারণে অ্যাজমা, ফুসফুসের রোগ, হৃদরোগে আগাম মৃত্যু, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, ঝাপসা লাগা, চর্মরোগ, ফুসফুসের ক্যানসার, কিডনি ও লিভারের সমস্যা, ব্লাড প্রেসার, শিশুদের স্বল্পবুদ্ধি হওয়ার মতো সমস্যা তৈরি হতে পারে।
এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দিকা সুলতানা বলেন, করোনায় আমাদের দেশে ওয়ানটাইম প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার ব্যাপক হারে বেড়েছে। প্লাস্টিক পণ্যের ক্ষতিকর দিক হলো এর মধ্যে গরম কিছু দিলে, তাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা মিশে শরীরে প্রবেশ করে, যা থেকে ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। বারবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্য থেকেও মানুষ প্লাস্টিক খাচ্ছে।
করোনা থেকে রক্ষায় আমরা হ্যান্ড গ্লাভস, মাস্ক ব্যবহার করে ফেলে দিচ্ছি। এগুলো মাটি, পানি, বায়ুতে দীর্ঘদিন থেকে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ করছে। সেই সঙ্গে যারা এসব বর্জ্য সংগ্রহ করছেন তাদের স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। কিন্তু এই বিষয়ে কোনো নজরদারি বা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, পরিবেশের কথা চিন্তা না করে আমরা এসব বর্জ্য যেখানে-সেখানে ফেলছি। একসময় সেটা আমাদের খাদ্যচক্রে মিশে যাচ্ছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, প্লাস্টিক ও পলিথিনে বাস্তুসংস্থান নষ্ট হচ্ছে। মাটি থেকে পানি, পানি থেকে জলজ প্রাণী এবং সেখান থেকে মানবদেহে প্রবেশ করছে প্লাস্টিক। এগুলো মানবদেহে কী ক্ষতি করে, তা নিয়ে এখনো বিস্তর গবেষণা হয়নি। তবে এটি ক্যানসার সৃষ্টির বড় কারণ বলে মনে করা হয়।
পূর্ববর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ