মাহফুজ মামুন: প্রতিভাবান কিশোরী ফুটবলার মারিয়ার যাতায়াত খরচ দিতে না পারায় বন্ধ হয়েছে ফুটবল খেলার অনুশীলন। দিনমজুর পিতার পক্ষে প্রতিদিন খরচ বহন করা অসম্ভব হওয়ায় মেয়ের ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ফিঁকে হচ্ছে। কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফুটবল অনুশীলনের জন্য বাবার ভ্যান গাড়িতে করে চুয়াডাঙ্গায় আসেন চাঁনমতি। আত্মবিশ্বাস আর চেষ্টার কাছে হার মেনেছে দারিদ্রতা। দারিদ্রতা তাদের ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন থামাতে পারেনি কিন্তু সামর্থ থাকলেও সামাজিক বাধায় থমকে যাচ্ছে। ফুটবল একাডেমির বিথী, রুপালি, রুমানা সিনথিয়া, বিদিশা, রতœাসহ সকল খেলোয়ার অস্বচ্ছল পরিবার থেকে উঠে আসা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে ফুটবলারদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।
চুয়াডাঙ্গা আলোকদিয়া গ্রামে দরিদ্র পরিবারে জন্ম মারিয়ার। সে রোমেলা খাতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী। বাবা নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। প্রতিদিন কাজ না থাকলে পড়তে হয় আর্থিক সঙ্কটে। গ্রাম থেকে চুয়াডাঙ্গায় অনুশীলনে আসতে ৫০-৬০ টাকা যাতায়াত খরচ লাগে। যাতায়াত খরচ বহন করতে না পারায় বন্ধ রয়েছে প্রতিভাবান কিশোরী ফুটবলারের অনুশীলন। মারিয়া বাদে গ্রামের অন্যরা ঠিকই আসছেন মাঠে।
দরিদ্র পরিবারে জন্ম চাঁনমতির। লেখাপড়ার পাশাপাশি নিয়মিত ফুটবল অনুশীলন করছে। প্রতি ভোরে বাবার সাথে ভ্যানগাড়িতে চড়ে চুয়াডাঙ্গার পুরাতন স্টেডিয়াম মাঠে ছুটে আসে। বাবা মেয়েকে নিতে আবার ছুটে আসেন। মামা দামুড়হুদা এলাকার একটি জৈব সার কারখানায় দিন মজুরের কাজ করেন। আলুকদিয়া হাতিকাটা গ্রামে ছোট্ট একটি খুপড়ি ঘরে মা-বাবা, দাদি, ভাইয়ের সাথে থাকেন চাঁনমতি। পড়াশুনার পাশপাশি সেরা ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। জাতীয় দলের হয়ে দেশে ও বিদেশে খেলার স্বপ্ন দেখে দু চোখ জুড়ে।
চুয়াডাঙ্গার মহাতাব উদ্দীন ফুটবল একাডেমি গড়ে উঠেছে ২০২০ সালে। করোনাকালীন সময়ে ঘরবন্দি জীবন থেকে মেয়েদের মুক্ত করতে এ ব্যাতিক্রম উদ্যোগ নেন সাবেক ফুটবলার মিলন বিশ্বাস। ২৫ জন কিশোরী ফুটবলার নিয়ে একাডেমির যাত্রা শুরু হয়েছে। মেয়েদের ফুটবল খেলাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে চায় না পরিবার ও স্থানীয়রা। নানা প্রতিকূলতা মাড়িয়ে প্রতিদিন মাঠে আসছেন। যারা ফুটবল খেলতে পারতো না, এখন তারা ফুটবলকে আয়ত্তে নিতে পারছেন। তারা বল রিসিভ, সুট, কাটসহ সব কিছুই রপ্ত করে পরিণত ফুটবলার হচ্ছে। বুট পায়ে দিয়ে সহজে ছোটাছুটি করতে পারে। একাডেমি থেকে ফুটবলারদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়। প্রতিদিন সকালে কিশোরীরা আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা একটানা অনুশীলন করেন।
খেলোয়ারদের চেহারায় ফুটে ওঠে দারিদ্রতা। শতবাধা পেরিয়ে একাডেমির, বিথী, রুপালি, মানিয়াসহ সকলে ফুটবলার হওয়ার জন্য সংগ্রাম করছেন। বেঁচে থাকার জন্য দু’বেলা অন্ন জোগাড় কষ্ট সাধ্য, ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখা বিলাসিতা। বেশীর ভাগ খেলোয়ারের পারিবারিক অবস্থা বেশ নাজুক। যা তাদের চেহারা ও পোশাকে ফুটে ওঠে। ফুটবল অনুশীলনের পর তাদের যে খাবারের প্রয়োজন তা কখনও চোখে দেখে না। শারীরিক ফিটনেসের জন্য প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার। সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা পেলে এরা একদিন সেরা খেলোয়ার হতে পারবে। চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন গ্রাম থেকে কিশোরী ফুটবলাররা আসেন।
মহাতাব উদ্দিন একাডেমির কিশোরী ফুটবলাররা হলেন বিথী, রুপালি, মারিয়া, রুমানা, সিনথিয়া, জুলেখা, তনিমা, বিদিশা, সুরাইয়া, রতœা, কোহিলি, রিভা, সিজ্যাতি, হাফিজা, সাদিয়া, মানিয়া প্রমুখ।
কিশোরী ফুটবলার মানিয়া বলেন, ফুটবল খেলা গ্রামের মানুষ ভালো চোখে দেখে না। তারা অনেক খারাপ কথা বলে। সে কারণে মা-বাবা ফুটবল খেলতে নিষেধ করেন। পরিবার থেকে বিয়ের কথা বলতো। কিন্তু আমি বিয়ে করতে চাইনি। পড়াশোনার পাশাপাশি ফুটবল খেলতে চাই।
চুয়াডাঙ্গার আলুকদিয়া মনিরামপুর গ্রামের মেয়ে মারিয়া জানান, বাবা রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন। প্রতিদিন কাজ থাকে না। বাড়ি থেকে মাঠে আসতে ৫০ টাকার মত লাগে। সে কারণে মা-বাবা নিষেধ করেছে ফুটবল খেলতে। আমার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও আর্থিক অভাবে অসম্ভব হয়ে পড়ছে। অন্যদের মতো ফিরতে চাই খেলার মাঠে। পরিবারে ইচ্ছা আছে আমি ভালো খেলোয়ার হয়।
চুয়াডাঙ্গার আলুকদিয়া হাতিকাটা গ্রামের মেয়ে চাঁনমতি বলেন, দরিদ্রতা আমাদের নিত্য সঙ্গী। বাবার ভ্যান গাড়িতে চড়ে মাঠে আসা যাওয়া করি। মা সংসারে হাল ধরতে কাজ করেন। ভালো পোশাক ও খাবার বাবার পক্ষে দেয়া সম্ভব না। স্বপ্ন দেখি লাল-সবুজের জার্সিতে গায়ে দেশের হয়ে খেলবো।
ফুটবলার মানিয়ার বাবা আব্দুল মাজিদ বলেন, গ্রামের অনেকে অনেক কথা বলে। তখন খারাপ লাগে। আমি চাই পড়াশোনা আর খেলাধুলা চালিয়ে যাক। কারও কথায় কান দিতে চাই না।
মহাতাব উদ্দিন বিশ্বাস ফুটবল একাডেমির পরিচালক মিলন বিশ্বাস জানান, অনেক স্বপ্ন নিয়ে একাডেমি করেছি। মেয়েদের খেলার মাঠে নিয়ে আসতে ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে। আর্থিক সঙ্কটের কারণে মেয়েরা নিয়মিত মাঠে না আসতে পারলে কষ্ট হয়। মেয়েরা অনেক ভালো ফুটবল খেলে। তাদের নিয়ে আমি আশাবাদী। সহযোগিতা পেলে নারী ফুটবল এগিয়ে নিতে পারতাম। একাডেমিতে অনেক ভালো খেলোয়ার আছে। যারা ঢাকায় খেলতে পারবে।
মহাতাব উদ্দিন বিশ্বাস নারী ফুটবল একাডেমি প্রধান উপদেষ্টা মাহাবুবুল ইসলাম সেলিম বলেন, চুয়াডাঙ্গায় প্রথম নারী ফুটবল একাডেমি এটি। মেয়েদের মাঠে নিয়ে আসাটা প্রথম দিকে চ্যালেঞ্জ ছিলো। একাডেমির অনেক মেয়ে দরিদ্র পরিবারের। তাদের জন্য প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা। একাডেমিতে ভালো ফুটবলার রয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নঈম হাসান জোয়ার্দ্দার বলেন, স্কুলে পড়া কিশোরী মেয়েদের নিয়ে ফুটবল একাডেমি গড়ে উঠেছে। পুরাতন স্টেডিয়াম মাঠটি মেয়েদের খেলার জন্য উপযোগী করা হয়েছে। তাদের আমরা ফুটবল, বুট, হুজ, জার্সিসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে সহযোগিতা করছি। এখান থেকে খেলোয়ার বাছাই করে জেলার জন্য একটি ভালো দল গঠন করতে চাই।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার সাদিকুর রহমান বলেন, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার একটি কিশোরী ফুটবল একাডেমি আছে। আমাদেরকে যদি জানানো হয় তাদের ফুটবল খেলার আর্থিক সঙ্গতি নেই, তাহলে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। নারীরা খেলার মাঝে থাকুন। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে খেলাধুলার বিকল্প নেই।
চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য হাজি আলী আজগর টগর এমপি বলেন, ফুটবল একাডেমির সাথে আমি সবসময় থাকবো। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। চুয়াডাঙ্গার নারী ফুটবল একাডেমির বিষয়টি টেলিভিশনের সংবাদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। বর্তমান সরকার নারীর জন্য কাজ করছে। জেলার মেয়েরা যে ফুটবল খেলতে পারে এতে আনন্দিত। কিশোরী ফুটবলাদের উন্নয়নের জন্য সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। চুয়াডাঙ্গার মেয়েরা দেশে-বিদেশে ফুটবল খেলুক।