কেরুজ চিনিকলের ২০২০-২১ আখ মাড়াই মরসুমের যাত্রা শুরু হচ্ছে ১৮ ডিসেম্বর

লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও লোকসানের বোঝা কমাতে প্রস্তুত চিনিকল কর্তৃপক্ষ ॥ চলতি রোপণ মরসুম হুমকির মুখে
দর্শনা অফিস: অবশেষে আগামী ১৮ ডিসেম্বর কেরুজ চিনিকলের ২০২০-২১ আখ মাড়াই মরসুমের যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষ। গত ৪ ডিসেম্বর চলতি মরসুমের কার্যক্রম চালু হওয়ার কথা থাকলেও শ্রমিক-কর্মচারীদের আন্দোলন কর্মসূচির মুখে তা ভেস্তে যায়। কেরুজ চিনিকল এলাকাসহ এবার কুষ্টিয়া জগতি চিনিকল এলাকার আখও মাড়াই করা হবে কেরুজ চিনিকলে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও লোকসানের বোঝা কমাতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেছে নানামুখি পদক্ষেপ। চলমান শ্রমিক আন্দোলনের কারণে ইক্ষু রোপণ মরসুম হুমকির মুখে পড়তে পারে। সেই সাথে আগামী মরসুমে ডিস্টিলারী কারখানায় উৎপাদন হতে পারে বিঘিœত। দেশের ১৫টি চিনিকলের সবগুলোই লোকসানের খাতায়। কেরুজ চিনি কারখানায় লোকসান হলেও তা পুষিয়ে দেয়া হয়ে থাকে ডিস্টিলারি বিভাগ থেকে। ফলে বরাবরের মতো গত অর্থ বছরেও সব ধরনের লোকসান পুষিয়ে কেরুজ কমপ্লেক্স মুনাফা অর্জন করেছে সাড়ে ১৪ কোটি টাকা। দেশের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে কুষ্টিয়া জগতি, পাবনা, শ্যামপুর, রংপুর, পঞ্চগর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকলের লোকসানের বোঝা বেশী ভারী হওয়ায় সরকার সে মিলগুলোতে চলতি আখ মাড়াই মরসুমে কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। এ ইস্যুতে শ্রমিক সংগঠনগুলো মাঠ গরম করছে আন্দোলনের নামে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি আন্দোলনকারীদের। শেষ পর্যন্ত চলমান আন্দোলনের মধ্যেও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ৬টি চিনিকলের আখ মাড়াই।
জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে কেরুজ কমপ্লেক্স ৫টি বিভাগের মধ্যে চিনি, সার ও খামারে লোকসান গুনেছে ৭৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এ দিকে মুনাফা অর্জিত হয়েছে ডিস্টিলারি ও ফার্মাসিটিক্যাল বিভাগ থেকে। ৪৮ লাখ ৬৬ হাজার প্রুপলিটার দেশী ও বিদেশী মদ উৎপাদন করে কেরুজ ডিস্টিলারি বিভাগ থেকে মুনাফা অর্জন হয়েছে ১৫৩ কোটি টাকা। চিনি কারখানায় ৭০ কোটি ৭৭ লাখ ৪৪ হাজার ৪৫১ টাকা, খামারে ৪ কোটি ২১ লাখ ৬১ হাজার ৪৫৩ টাকা, আকন্দবাড়ীয়া সার কারখানায় ২২ লাখ ৭৭ হাজার ৫২৮ টাকা লোকসান হয়েছে। এ দিকে ডিস্টিলারি কারখানায় মুনাফা অর্জন করেছে ৮৮ কোটি ৩৯ লাখ ২৯ হাজার ১২৪ টাকা, ফার্মাসিটিক্যালে ভিনেগার উৎপাদনে মুনাফা অর্জিত হয়েছে ৩২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা, ৪০৫ টাকা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার উৎপাদনে ১ কোটি ১ কোটি ২ লাখ ২ হাজার ৮৪৮ লাখ টাকা মুনাফা অর্জন হয়েছে। সর্বমোট মুনাফা অর্জন থেকে ওই অর্থ বছরে সরকারের রাজস্ব খাতে ভ্যাট ও শুল্ক আয় জমা দিতে হয়েছে ৬৫ কোটি টাকা। অবশিষ্ট মুনাফার ৮৮ কোটি ৩৯ লাখ ২৯ হাজার টাকার মধ্যে চিনি, খামার ও সার কারখানার লোকসান পোষানো হয়েছে ৭৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। সরকারের খাতায় রাজস্ব দিয়ে, তিনটি বিভাগের লোকসান পুষিয়েও ২০১৯-২০ অর্থ বছরে কেরুজ কমপ্লেক্স মূল মুনাফা অর্জন করেছে ১৪ কোটি ৫২ লাখ ৩৬ হাজার ৯৪৬ টাকা। ফলে লাভজনক কেরুজ কমপ্লেক্স বন্ধ করার কোনো আশঙ্কা নেই বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। এদিকে কেরুজ চিনিকলে টানা আন্দোলন কর্মসূচির কারণে মিলের কার্যক্রম যেমন হচ্ছে ব্যাহত, তেমনিভাবে আখচাষিরা হতাশ হয়ে রোপণ কার্যক্রমে আগ্রহ হারাচ্ছে। যে কারণে চরম হুমকির মুখে পড়তে হতে পারে আগামী আখ মাড়াই মরসুম। অনেকেই মন্তব্য করে বলেছে, কেরুজ চিনিকল শ্রমিক নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ চিনিকল শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা হওয়ায় এ মিলে দেখাচ্ছেন তাদের বাহাদুরি। আসলে নেপথ্যে রয়েছে রহস্য। অনেকেই মন্তব্য করে বলেছে, শ্রমিক নেতাদের মধ্যে কারও কারও বিরুদ্ধে রয়েছে নিয়োগ ও বদলি বানিজ্যের আতঙ্ক। কোনোভাবে কেরুজ চিনিকল বন্ধ হলে তথাকথিত নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যের জন্য মাশুল দিতে হবে সে সকল নেতাকেই। গত ৪ ডিসেম্বর কেরুজ চিনিকলের ২০২০-২১ আখ মাড়াই মরসুম শুরু হওয়ার নির্ধারিত দিন থাকলেও আন্দোলনের মুখে পিছিয়ে ১৮ ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়। সেলক্ষ্যে কেরুজ চিনিকল জোড়া-তালি, ধোয়া-মুছা ও রং-চুনের হিড়িক পড়েছে বেশ আগেই। এ মরসুমে কেরুজ ১ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিকটন আখ মাড়াই করে ৯ হাজার ৬২৫ মেট্রিকটন চিনি উৎপাদন করবে কেরুজ চিনিকল। কেরুজ চিনিকলের নিজস্ব ১ হাজার ৫শ ৫০ একর জমিতে ২৪ হাজার মেট্রিক টন আখ, কৃষকের ৬ হাজার ৯শ ৮২ একর জমির ৯৪ হাজার মেট্রিকটন আখ। এছাড়া বন্ধ হওয়া কুষ্টিয়া চিনিকলের আওতাধীন কৃষকদের ৩৬ হাজার মেট্রিকটন আখ মাড়াই করা হবে কেরুজ চিনিকলে। ফলে এবারের মাড়াই দিবস নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৪। চিনি আহরণের গড় হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ দশশিক ২৫ শতাংশ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিনেই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করা হয় ২০২০-২১ ইক্ষু রোপণ মরসুমের কার্যক্রম। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৯ হাজার ৩৫০ একর জমির। এর মধ্যে চিনিকলের নিজস্ব জমির পরিমাণ ৮৫০ একর, বাকী ৮ হাজার ৫শ একর জমি কৃষকের। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ দিন অবধি এ ইক্ষু রোপণ কার্যক্রম চলবে। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্র্যন্ত ইক্ষুরোপন করা হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৪শ সাড়ে ৪২ একর জমিতে। এখনও ৭ হাজার ৯শ সাড়ে ৭ একর জমিতে ইক্ষু রোপণ বাকী রয়েছে। এরই মধ্যে শ্রমিক-কর্মচারীদের আন্দোলনের কারণে আখচাষিরা অনেকটাই না বুঝে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে এ চাষের প্রতি। যা আগামী মাড়াই মরসুমের জন্য চরমভাবে হুমকির কারণ হিসেবে দাঁড়াতে পারে। শুধু চিনিকলই নয়, আখচাষিরা রোপণ মরসুমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আখচাষে না নামলে আগামীতে ডিস্টিলারি কারখানায় উৎপাদনও হুমকির মুখে পড়তে পারে। কারণ হিসেবে জানা গেছে, আখের চিটাগুড় ডিস্টিলারি পণ্য উৎপাদনে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়া কেরুজ চিনিকল বাদে দেশের অন্য ১৪টি চিনিকলে বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ সারের মূল্য বাবদ ৫৫ কোটি টাকা পাওনা। যে কারণে বিসিআইসি সার সরবরাহ বন্ধ করেছে। যেহেতু কেরুজ চিনিকলে কোনোপ্রকার বকেয়া বাকী নেই, সেহেতু যতদ্রুত সম্ভব কেরুজ চিনিকলে সার সরবরাহের মাধ্যমে কৃষকদের মাঝে দেয়া হবে বলেও জানায় কেরুজ কর্তৃপক্ষ। কেরুজ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবু সাঈদ জানান, কেরুজ চিনিকল বন্ধ হওয়ার কোন সম্ভবনা নেই। কারণ কেরুজ কমপ্লেক্স একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। যে সকল চিনি কারখানায় লোকসান হচ্ছিলো সেগুলোর মধ্যে ৬টি চিনিকলে আখ মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। সেক্ষেত্রে আমাদের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমাদের উচিৎ সরকারের মূল্যবান এ সম্পদটি বাঁচিয়ে রাখতে অনেক বেশী পরিমাণে আখচাষ করা। সেই সাথে শ্রমিক-কর্মচারীদের হতে হবে কর্মমুখি। কেরুজ এমডি মো. আবু সাঈদ আরও বলেন, কোনো আখচাষি হতাশ হবেন না। কোনভাবে এ মিল বন্ধ হচ্ছে না ইনশাল্লাহ। সরকারের এ মূল্যবান সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব আপনাদেরই। তাই কান কথায় কান না দিয়ে আখচাষের প্রতি আগ্রহী হোন। মনে রাখবেন যে প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘ ৮২ বছর এ অঞ্চলকে আলোকিত করে রেখেছে, অর্থনৈতিকভাবে করেছে সমৃদ্ধ, সেই প্রতিষ্ঠানটি যাতে বন্ধ না হয় সে জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান রইলো।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More