কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর : সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড়
কর্মসূচির মধ্যদিয়ে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠন
স্টাফ রিপোর্টার: কুষ্টিয়ায় নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের প্রতিবাদে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় বইছে। শুক্রবার রাতে কোনো একসময় ভাস্কর্যটির ডান হাত, পুরো মুখ ও বাম হাতের অংশবিশেষ ভেঙে ফেলা হয়। এর প্রতিবাদে শনিবার বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন, মশাল মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পক্ষের বিভিন্ন সংগঠন। এসব কর্মসূচি থেকে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি, সাম্প্রদায়িক, উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর চক্রান্ত প্রতিহত করতে লাগাতার কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার ঘোষণা দেয়া হয়। তবে ভাস্কর্য নিয়ে চলমান পরিস্থিতিতে সবাইকে মাথা ঠা-া রাখার পরামর্শ দিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নিজেই দেখছেন। ঢাকায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনে হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ইসলামী দলের বিরোধিতার মধ্যে কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলো। এদিকে শনিবার সন্ধ্যায় ভাস্কর্যটির সামনে মাইক্রোবাস থেকে ফাঁকা গুলি ছুড়েছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার পর সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
কুষ্টিয়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী যুবলীগ বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। গতকাল শনিবার রাত ৯টায় চুয়াডাঙ্গা মোহাম্মদী শপিং কমপ্লেক্সের সামনে থেকে জেলা আওয়ামী যুবলীগের আহ্বায়ক নঈম হাসান জোয়ার্দ্দার ও যুগ্মআহ্বায়ক জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদিক্ষণ করে পুনরায় একই স্থানে এসে শেষ হয়। পরে সেখানে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবাদ সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, জেলা আওয়ামী যুবলীগের আহ্বায়ক নঈম হাসান জোয়ার্দ্দার। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, জেলা আওয়ামী যুবলীগ সদস্য হাফিজুর রহমান হাপু, আজাদ আলী, আবু বকর সিদ্দিক আরিফ, সাজিদুর ইসলাম লাবলু, শরিফ হোসেন দুদু, আলমগীর আজম খোকা, অ্যাড. তসলিম উদ্দিন ফিরোজ, জেলা আওয়ামী যুবলীগ নেতা পিরু মিয়া, দরূদ হাসান, মাসুদুর রহমান মাসুদ, ফটিক, বিপ্লব, জুয়েল জোয়ার্দ্দার, আলিম, আলী ইমরান শুভ, রামিম হাসান সৈকত, সামিউল শেখ সুইট, তানভীর রেজা টুটুল, দিপু, আসাদ, কবির, সজল, বাচ্চু প্রমুখ।
মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে, কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙচুরের প্রতিবাদে মেহেরপুরে পৃথক পৃথক বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে যুবলীগ। গতকাল শনিবার রাতে মেহেরপুর জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান রিটনের নেতৃত্বে এ বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়।
মেহেরপুর পৌর কমিউনিটি সেন্টারের সামনে থেকে শুরু করে বিক্ষোভ মিছিলটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে মেহেরপুর প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে এক প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। মেহেরপুর জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ও পৌর মেয়র মাহফুজুর রহমান রিটনের সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য রাখেন মেহেরপুর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাড. ইয়ারুল ইসলাম, যুবলীগ নেতা সাজাদুর রহমান সাজু, জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি শোভন সরকার। বিক্ষোভ মিছিলে অন্যদের মধ্যে যুবলীগ নেতা মাহবুব ডালিম, হাসানুজ্জামান হিলোন, ইউনুস আলী, মেহেরপুর পৌর কাউন্সিলর নুরুল আশরাফ রাজিব প্রমুখ।
অপর দিকে একইদিন রাত ৯টার দিকে মেহেরপুর প্রেসক্লাবের সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে একই স্থানে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভ মিছিল ও সামাবেশের নেতৃত্ব দেন জেলা যুবলীগের যুগ্মআহ্বায়ক সরফরাজ হোসেন মৃদুল। যুবলীগের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে অংশ নেন।
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন, শুক্রবার রাতের আঁধারে বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্যের ডান হাত, পুরো মুখম-ল ও বাঁ-হাতের অংশবিশেষ ভেঙে ফেলে দুর্বৃত্তরা। শনিবার সকালে এ ঘটনা জানাজানি হলে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ ও জাসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠন বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল ও মানববন্ধন করে। ভাস্কর্য ভাঙচুরের প্রতিবাদে জেলা বিএনপির কার্যালয়ে হামলা চালানো হয়। এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন ও পুলিশ সুপার তানভির আরাফাতসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। কুষ্টিয়া পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, পৌরসভার উদ্যোগে শহরের প্রাণকেন্দ্র পাঁচরাস্তার মোড়ে গত মাসে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শুরু হয়। একই বেদিতে বঙ্গবন্ধুর তিন ধরনের তিনটি ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এছাড়া একই বেদিতে জাতীয় চার নেতার ভাস্কর্যও থাকবে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ প্রায় শেষের দিকে। তিনি জানান, শনিবার রাতে দুর্বৃত্তরা ভাস্কর্যটির ডান হাত, পুরো মুখম-ল ও বাঁ-হাতের অংশবিশেষ ভেঙে ফেলেছে। ভাস্কর মাহাবুব জামান শামীম জানান, ভাস্কর্যটি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের প্রতীক। যারা এটি ভাঙার দুঃসাহস দেখিয়েছে তাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে। জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন বলেন, রাতের আঁধারে যারা এ অপকর্ম করেছে তারা কাপুরুষ। এ ঘটনায় জড়িতদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না। তিনি বলেন, বিজয়ের মাসে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। যারাই এ ভাস্কর্য ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পুলিশ সুপার এসএম তানভির আরাফাত জানান, সিসিটিভির ফুটেজ দেখে ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করা হয়েছে। শিগগিরই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন কুষ্টিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক কারশেদ আলম জানান, এটি খুবই গর্হিত অপরাধ। মৌলবাদী অপশক্তি এসব করে দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। তাদের সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের প্রতিবাদে বের করা মিছিল থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা জেলা বিএনপির কার্যালয়ে হামলা চালায়। এ সময় কার্যালয়ের চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করা হয়। জেলা বিএনপির সভাপতি সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী বলেন, কোনো ভাঙচুরের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মী জড়িত নেই। অথচ বিএনপি কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়েছে।
এদিকে, শনিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে শহরের ব্যস্ততম এলাকা পাঁচরাস্তা মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের সামনে মাইক্রোবাসে এসে এক যুবক পুলিশের উপস্থিতিতে পিস্তল উঁচিয়ে দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এরপর দ্রুত মাইক্রোবাসে মজমপুর গেট দিয়ে চৌড়হাঁসের দিকে যুবকটি চলে যায়। ঘটনাটি পুলিশ লাইনসের উপপরিদর্শক (এসআই) মকছেদুর রহমান প্রত্যক্ষ করেন। তবে তিনি তাকে আটকাতে পারেননি। ভাস্কর্য এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
ঢাকা অফিস জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের প্রতিবাদে লাগাতার কর্মসূচির মধ্যদিয়ে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলো। এ ঘটনার প্রতিবাদে রোববার যুবলীগ, ছাত্রলীগ, যুব মহিলা আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ আরও বেশ কয়েকটি সংগঠন ঢাকাসহ সারাদেশে মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতাকে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী’ ও ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ আখ্যা দিয়ে তা রুখতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সব রাজনৈতিক শক্তিকে এক কাতারে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন সংস্কৃতিকর্মীরা। বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানববন্ধন কর্মসূচিতে এ আহ্বান জানানো হয়।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, রাজনীতি নিয়ে আমাদের মতভেদ থাকতে পারে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কারও ভিন্নমত থাকা উচিত নয়। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ রক্ষা করতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সবশক্তিকে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও একাত্তরের আদর্শের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখে দিতে ১১ ডিসেম্বর সব উপজেলায় প্রতিবাদী মানববন্ধন করা হবে।
ভাস্কর্যের বিরোধিতার নামে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননার অভিযোগে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমীর ফয়জুল করিমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার ঘোষণা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে মঞ্চের নেতারা জানান, রোববার আদালতে মামলা করা হবে।