স্টাফ রিপোর্টার: অবশেষে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু হতে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গোষ্ঠীর অব্যাহত চাপ ও বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও আগামী দু-একদিনের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের প্রথম দল যাচ্ছে ভাসানচরে। ৩০০ পরিবারের প্রায় আড়াই হাজার রোহিঙ্গাদের দলটি কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলো থেকে সরাসরি ভাসানচরের অত্যাধুনিক আবাসন প্রকল্পে যাবেন। রোহিঙ্গাদের এই অংশটি সম্পূর্ণ নিজেদের ইচ্ছায় ভাসানচরে গিয়ে থাকতে রাজি হয়েছেন। পর্যায়ক্রমে আরও এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হবে। সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছু দ্দৌজা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের একটি দল ভাসানচরে স্থানান্তরের যাবতীয় প্রস্তুতি চলছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক, তাদের তালিকা পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে। তবে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক কমডোর আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী বলছেন, আমরা পুরো ১ লাখ রোহিঙ্গাকেই আশ্রয় দেয়ার জন্য শতভাগ প্রস্তুত। যখনই তাদের আনা হোক তারা এখানে বসবাস করতে পারবে।
জানা যায়, কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির ও তার বাইরে অবস্থান নিয়ে থাকা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে নানা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে দুই বছর আগে তাদের একটি অংশকে হাতিয়ার কাছে মেঘনা মোহনার দ্বীপ ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। তবে, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর অনাগ্রহ ও নানা ধরনের বাহানার কারণে এতদিন তাদের সেখানে স্থানান্তর সম্ভব হয়নি।
করোনা মহামারীর শুরুর দিকে সাগর থেকে উদ্ধার করা ৩০৬ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরে পাঠানো হয়। গত ৫ সেপ্টেম্বরে সরকার ‘গো অ্যান্ড সি’ প্রকল্পের অধীনে ৪০ জন রোহিঙ্গা নেতাকে চার দিনের সফরে ভাসানচর দেখাতে নিয়ে যায়। ভাসানচরে পরিদর্শন শেষে তারা জানিয়েছিলেন, ভাসানচরের সুবিধাদি দেখে ভালো লেগেছে। এরই মধ্যে ২২টি এনজিও থেকে দেওয়া পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ভাসানচরে পৌঁছেছে।
রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরে আশ্রয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের এক সভায় ভাসানচরের জন্য নেওয়া প্রকল্পের খরচ ৭৮৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা করা হয়। মোট ১২০টি ক্লাস্টার এবং ১২০টি শেল্টার স্টেশন নিয়ে গড়ে উঠেছে ভাসানচরের এ আশ্রয়ণ প্রকল্প। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। আগের ৪ লাখসহ বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার চুক্তি করলেও মিয়ানমারের অনাগ্রহের কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। পরপর দুবার প্রত্যাবাসনের খুব কাছাকাছি গিয়েও একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে পাঠানো যায়নি।
সম্পৃক্ততা নেই জানাল জাতিসংঘ : রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেওয়ার যে পরিকল্পনা সরকার চূড়ান্ত করেছে, তার সঙ্গে জাতিসংঘের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই বলে এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে জাতিসংঘ। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে ভাসানচরে যাওয়ার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা যেন সব তথ্য জেনে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। গতকাল এক বিবৃতিতে এই বিশ্ব সংস্থা বলেছে, এই স্থানান্তর প্রক্রিয়ার প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রমে, অথবা শরণার্থীদের শনাক্ত করার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। স্থানান্তরের সার্বিক কর্মকান্ড সম্পর্কে জাতিসংঘের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। স্থানান্তরের বিষয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যেন ‘প্রাসঙ্গিক, নির্ভুল এবং হালনাগাদ’ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ বরাবরই আহ্বান জানিয়ে এসেছে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতেও জাতিসংঘ এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করছে। ইতিপূর্বে বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে যে ওই দ্বীপে শরণার্থীদের স্থানান্তর হবে স্বেচ্ছামূলক। জাতিসংঘ এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছে। ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং জীবিকার নিশ্চয়তা বিধানের পাশাপাশি দ্বীপ থেকে মূল ভূখন্ডে চলাচলের স্বাধীনতা দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে বিবৃতিতে। যে সব শরণার্থী ভাসানচরে স্বেচ্ছায় স্থানান্তরিত হতে চাইবেন, ওই দ্বীপে তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং জীবিকার নিশ্চয়তা এবং দ্বীপ থেকে মূল ভূখন্ডে চলাচলের স্বাধীনতাসহ সব মৌলিক অধিকার, এবং মৌলিক সেবা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ গুরুত্ব আরোপ করেছে। এটি ভাসানচরে একটি কার্যক্ষম ও নিরাপদ জনপদের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। স্থানান্তর ঘিরে আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে জাতিসংঘ বলছে, বাংলাদেশ সরকার ভাসানচর প্রকল্পের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে এই পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত, পদ্ধতিগত এবং বাস্তবায়ন সম্পর্কিত বিষয়গুলো বিবেচনার জন্য গঠনমূলক আলোচনার প্রস্তাব রেখেছে জাতিসংঘ। এই আলোচনা চালিয়ে যেতে জাতিসংঘ এখনো আগ্রহী। ভাসানচরে স্থানান্তর বিষয়ে আগে থেকে টেকনিক্যাল প্রোটেকশন অ্যাসেসমেন্ট করার প্রস্তাবও দিয়ে আসছে জাতিসংঘ। বিবৃতিতে বলা হয়, জাতিসংঘের এই নিরপেক্ষ মূল্যায়নে শরণার্থীদের বাসস্থান হিসেবে ভাসানচরের নিরাপত্তা, প্রায়োগিক সম্ভাব্যতা, স্থায়িত্ব এবং শরণার্থীদের সুরক্ষা কাঠামো এবং তাদের সহায়তা ও সেবা-গ্রহণের অবকাঠামোর সার্বিক পর্যালোচনা করা হবে। সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে, জাতিসংঘ প্রায়োগিক এবং সুরক্ষাবিষয়ক মূল্যায়ন করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। জাতিসংঘ সরকারের ভাসানচর প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত হতে পারবে কি না, সেটা নির্ধারণে এই মূল্যায়নগুলো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে।