ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতিকে ‘প্র্যাকটিস নির্দেশনা’ জারির অনুরোধ করা হবে -আইনমন্ত্রী
স্টাফ রিপোর্টার: ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০০০’-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার ভার্চুয়াল বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হলেও সচিবালয় থেকে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে সংসদ অধিবেশন না থাকায় রাষ্ট্রপতির অনুমতি নিয়ে আজ মঙ্গলবারই (১৩ অক্টোবর) এ ব্যাপারে অধ্যাদেশ জারি করা হবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, ‘সংশোধিত আইন মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সংশোধিত আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড যাবজ্জীবনও থাকছে।’ মন্ত্রী বলেন, ‘আমি মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করবো, তিনি যেনো প্র্যাকটিস নির্দেশনা দেন, যেনো বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এসব মামলার বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেন। অপরদিকে আইন মন্ত্রণালয় থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে যে স্টেশন পিপিরা আছেন, তাদের নির্দেশনা দেব-যে মামলাগুলো শেষ করার জন্য ইমিডিয়েট পদক্ষেপ নাও।’ অন্যদিকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা বলেছেন, ‘নারী ও শিশু ধর্ষণ জঘন্যতম অপরাধ। এ অপরাধ কঠোরভাবে দমন করতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান করা হয়েছে। আশা করি, এ আইনের বাস্তবায়নের মাধ্যমে ধর্ষণমুক্ত হবে দেশ।’
বৈঠক শেষে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, গত কিছুদিনের ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন অপরাধগুলো কঠোরভাবে দমনের প্রস্তাব আনা হয়। বর্তমানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে যদি কোনো পুরুষ নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে তিনিযাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ-ে দ-িত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব আসে যে, নারী বা শিশু ধর্ষণ জঘন্য অপরাধ, সমাজে নারী বা শিশু নির্যাতন কঠোরভাবে দমনের লক্ষ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এ ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড করার লক্ষ্যে আইনের সংশোধন প্রয়োজন। যেহেতু বর্তমানে সংসদের অধিবেশন নেই, কিন্তু দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে, সে জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সন্তোষজনক হলে তিনি সংবিধানের দেয়া ক্ষমতাবলে অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন। আইনের ধারা ৯(১)-এ যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ-ের পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড- প্রতিস্থাপিত হবে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। মন্ত্রিসভায় এগুলো বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন এবং পরে মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত দিয়েছে যে, প্রস্তাবটা গ্রহণযোগ্য এবং অবিলম্বে তা করা প্রয়োজন। যেহেতু এখন সংসদ কার্যকর নয়, সে জন্য এটা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে। বিষয়টি লেজিসলেটিভ বিভাগের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আইনের ১১(গ) এবং ২০(৭) ধারা সংশোধন করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ধর্ষণ ছাড়া সাধারণ জখম হলে কম্পাউন্ড (আপসযোগ্য) করা যাবে। আর চিলড্রেন অ্যাক্ট, ১৯৭৪ প্রযোজ্য হবে না। এখন শিশু আইন, ২০১৩ প্রযোজ্য হবে। কতদিনের মধ্যে বিচার শেষ করা হবে-এমন প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ১৮০ দিনের মধ্যে মামলার বিচার শেষ করতে হবে। তদন্ত, বিচার পদ্ধতি-সবকিছুই উল্লেখ করা আছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচার হবে। যদি কোনো বিচারক চলে যান, তাহলে তিনি যে অবস্থায় রেখে গেছেন, সেই অবস্থা থেকে পরে বিচার হবে। এমনিতে এক লাখ টাকা জরিমানা আছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, এর বাইরে ক্ষতিপূরণের বিধান আছে। এ ক্ষতিপূরণের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তা অপরাধীর বিদ্যমান সম্পদ থেকে আদায় করা না গেলে ভবিষ্যতে তিনি যে সম্পদের মালিক হবেন, তা থেকে আদায় করা হবে। ধর্ষণের সংজ্ঞার পরিবর্তনের বিষয়ে কোনো কথা হয়েছে কি না-জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘ডেফিনেশনের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।’
এক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, শুধু আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। অনেকগুলো দেশের আইন চেক করে দেখেছে আমাদের আইন মন্ত্রণালয় ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়। আর বর্তমান পরিস্থিতি ও বাস্তবতা-সবকিছু মিলিয়েই এটা হয়েছে। শুধু আন্দোলনের জন্য তো জিনিসটা আসেনি। সরকারের মধ্য থেকেও এটার পক্ষে একটা প্রচারণা আসছে। মানুষের অ্যাওয়ারনেসের কারণে হয়তো এটা আসছে, সেটা হতে পারে।
সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করে কোনো লাভ হবে কি না-এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘যেভাবে প্রমোশন ক্যাম্পেইন হচ্ছে, এটাও তো একটা প্রমোশনের জায়গা। এটা অবশ্যই সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যারা ক্রাইম করে তারা অন্তত দু’বার চিন্তা করবে-এটায় তে তো মৃত্যুদ- আছে। এখন তো আর যাবজ্জীবন কারাদ- নয়। ১৮০ দিন তো দীর্ঘ সময়ও নয়। ডেফিনেটলি এটার পজিটিভ ইম্প্যাক্ট হবে। এটা যাতে আরেকটু প্রমিনেন্টলি আসে ট্রায়ালে, সেটা চিন্তা করা হবে।’
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘সাজা বাড়ানোর যে ব্যাপারটা, এটা পরিস্থিতির কারণে। বিশ্বে মৃত্যুদ-ের ব্যাপারে অনেক বিতর্ক আছে। তারপরও আমাদের দেশে এই ঘৃণ্য অপরাধটির যে চিত্র দেখতে পাচ্ছি, সে কারণে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন এটা বাড়ানো উচিত। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারটি সংশোধনীতে এনেছি। আমরা আইনে বিশ্বাস করি। আইনি প্রক্রিয়ায় যতটুকু সময় লাগে সেই সময়ের মধ্যে ধর্ষণ মামলাগুলোর বিচার যাতে সম্পন্ন করা যায়, সেই চেষ্টা সরকার করবে। বিচার বিভাগ স্বাধীন। সেই স্বাধীনতা অবশ্যই রক্ষা করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘ধর্ষণের সাজা যাবজ্জীবন থেকে মৃত্যুদ- করায় এই অপরাধটি কমে আসবে, না হলে (শাস্তি) বাড়ানোর প্রশ্নে আসতাম না।’ ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করার প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর গুলশানে তার বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি আরও বলেন, ‘বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১-এর ১(গ) ধারায় যৌতুকের জন্য সাধারণ জখম করার ঘটনা আপসযোগ্য ছিল না। কিছুদিন আগে হাইকোর্ট বিভাগের একটি দ্বৈত বেঞ্চ ওই ধারা আপসযোগ্য করার রায় দেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৃহস্পতিবার কথা হয়। সাধারণ জখম ধারাটিকে আপসযোগ্য করা হয়েছে। যেহেতু সংসদ অধিবেশন নেই, সে জন্য আগামীকাল (আজ) রাষ্ট্রপতির আদেশবলে অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’