স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গার বহুল পরিচিত মুখ সাহিত্যানুরাগী বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস শুকুর বাঙালী ওরফে আ.শু বাঙালী আর নেই। তিনি গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৪টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহে…….রাজেউন)। তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা ইউনিট কমান্ডার হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। কেরুজ সিআইসি ছিলেন তিনি। সিবিআই নেতা হিসেবেও সুখ্যাতি ছিলো তার। বেশ কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর সোমবার তিনি করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দেন এবং মঙ্গলবার বিকেলে মারা যান। সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে যে রিপোর্ট এসেছে তাতে আশু বাঙালীর করোনা পরীক্ষা পজিটিভ এসেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. শামীম কবির।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কুলচারা গ্রামের মরহুম আফিল উদ্দিন ম-লের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.শু বাঙালী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। নিজ বাড়িতেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার বিকেলে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিলো ৭২ বছর। তিনি স্ত্রী, দু ছেলে, দুই মেয়ে নাতিসহ বহু গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। বাম আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক, দৈনিক মাথাভাঙ্গার এক সময়ের পাঠকপ্রিয় কলাম ‘জনতার একসিøপ’ লেখক আ.শু বাঙালীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে গোটা জেলায় শোকের ছায়া নেমে আসে। দৈনিক মাথাভাঙ্গা সম্পাদক সরদার আল আমিন ও বার্তা সম্পাদক আহাদ আলী মোল্লা তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। আজ বুধবার সকাল ১০টায় নিজ বাড়ি সংলগ্ন জামে মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে কুলচারা কেন্দ্রীয় কবরস্থানে তার দাফন কাজ সম্পন্ন করা হবে।
যখন বড় দুঃসময়, কলমের এক আঁচড়ে পরিবর্তিত হয়ে গেলো জাতীয়তার পরিচয়। কারাভ্যন্তরে অন্তরীণ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা নিজের পরিচয় সনদে যুক্ত করলেন গর্বিত অহঙ্কারে ‘বাংলাদেশি নই, আমি বাঙ্গালী’। আ. শু. বাঙালী। পূর্ণ নাম আব্দুস শুকুর। পরিচিত তিনি আ. শু. বাঙালী নামে। চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার উত্তর-পূর্ব কোণের গ্রাম কুলচারায় তার বসতভিটা। বাবা আফিল উদ্দিন ম-ল, মা জুলেখা খাতুনের জ্যেষ্ঠ সন্তান ছিলেন আব্দুস শুকুর। তিনি ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি শুক্রবার মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব-কৈশোর দস্যিপনায় মুখরিত করে তার বেড়ে ওঠা। নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে ভর্তি হন ভি.জে. হাইস্কুলে। ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করেন। তারপর চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস শেষে মানুষ গড়ার ব্রত নিয়ে শিক্ষকতা পেশা হিসেবে গ্রহণের জন্য কমলাপুর পিটিআই-তে ভর্তি হন ১৯৬৯ সালে। তখন দেশব্যাপী সামরিক জান্তা স্বৈরাচার আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে। ১১ দফা দাবির স্বপক্ষে দেয়াল-লিখনের মাধ্যমে প্রগতিশীল রাজনীতিতে পদার্পণ। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পথ ধরে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। ৮ নম্বর সাব-সেক্টরের ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান (পরবর্তীতে সেনাপ্রধান) এর অধীনে এক্সপেনাসিভ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মে মাসের মাঝমাঝি পর্যন্ত সীমান্তবর্তী এলাকায় দু-চারটি ছোটখাটো অপারেশন শেষে ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমানের নির্দেশে দেশের অভ্যন্তরে থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য প্রথমে ৩৬ জনকে নিয়ে নিজস্ব গেরিলাবাহিনী গড়ে তোলেন। এই বাহিনী চুয়াডাঙ্গার খাসকররা, নীলমণিগঞ্জ, পদ্মবিলা, সরোজগঞ্জ, গিরিশনগর, কালুপোল, খেজুরতলা, ঝিনাইদহের হরিণাকু-ু ও শৈলকুপা অঞ্চলে বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন চালায় এবং পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হয়। পরে এই গেরিলাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১২৭এ উন্নীত হয়।
ব্যক্তিজীবনে প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। স্বাধীনতা পূর্ব কিছুদিন ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত ছিলেন। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) চুয়াডাঙ্গা শহর শাখা ও পরবর্তীতে জেলা শাখার সাথে ২০১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কম-বেশি যুক্ত ছিলেন। ২০০৯-২০১৯ খ্রিস্টাব্দে জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পার্টির সকল পদ থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করেন। তবে পরবর্তীতে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পার্টির সাথে সখ্য বজায় ছিলো। কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড, দর্শনায় চাকরিকালীন ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাথে যুক্ত থেকে শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। টিইউসির নেতা হিসেবে রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন, পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, রেল শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার সাথেও যুক্ত ছিলেন। অল্প বয়স থেকে শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে জড়িত থাকার সুবাদে সকল স্তরে ছিলো তার পদচারণা। সমাজ-রাজনীতির বিভিন্ন অসঙ্গতি নিয়ে নিরলসভাবে তিনি একদা ‘জনতার একস্লিপ’, ‘নিম-নিশিন্দা’, ‘বাঙ্গালীর কড়চা’ শিরোনামে লিখতেন স্থানীয় ও জাতীয় পত্র-পত্রিকায়। চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদ, অরিন্দম সাংস্কৃতিক সংগঠন, বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ চুয়াডাঙ্গার সাথে প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই পদচারণা ছিলো তার। অরিন্দমের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। আমৃত্যু প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
আ.শু বাঙালীর মৃত্যুতে সাহিত্য ও সামাজিক অঙ্গনে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে জানিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও চুয়াডাঙ্গা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. তৌহিদ হেসেন শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপি নেতা শরীফুজ্জামান শরিফ, চুয়াডাঙ্গা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবু হোসেন, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি চুয়াডাঙ্গা ইউনিটের অর্থ সম্পাদক উজ্জ্বল মাসুদ, সাংস্কৃতি ও প্রকাশনা সম্পাদক হুসাইন মালিক, আন্দুলবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি নারায়ণ ভৌমিক, সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম মামুন। অন্যান্যের মধ্যে শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি চুয়াডাঙ্গা জেলা কমিটির সভাপতি অ্যাড. শহীদুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী) চুয়াডাঙ্গা জেলা কমিটির আহ্বায়ক সৈয়দ মজনুর রহমান ও যুগ্ম-আহ্বায়ক আলাউদ্দিন উমর, বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কাজল মাহমুদ ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কোরবান আলী ম-ল, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী চুয়াডাঙ্গা জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক হাবিবি জহির রায়হান ও ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুস সাত্তার, অরিন্দম সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভাপতি আব্দুস সালাম সৈকত ও সাধারণ সম্পাদক বজলুর রহমান জোয়ার্দ্দার, চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের সভাপতি হামিদুল হক মুন্সী ও সাধারণ সম্পাদক আনছার আলী।