বিনোদন ডেস্ক: বাড়ি ভাড়া, মেয়ের স্কুলের বেতন বাকি। লকডাউনের পর থেকে বাসার কাছের দোকান থেকে বাকি-বকেয়া করে সংসার চলছিলো। বাকি বেশি হয়ে যাওয়ায় দোকানদারও এখন আর জিনিসপত্র দিচ্ছেন না। পর্যাপ্ত খাবার না থাকায় মাঝেমধ্যে চুলাও জ্বলে না বাড়িতে। মেয়ের মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, কেন যে বেঁচে আছি।’ শনিবার দুপুরে কথাগুলো বলছিলেন কিশোর কুমারের ‘একদিন পাখি উড়ে’ গানটি কাভার করে আলোচনায় আসা গায়ক আকবর।
করোনা মহামারিতে ভীষণ কষ্টে কাটছে আকবরদের দিন। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে না পারায় এরই মধ্যে বেড়ে গেছে শারীরিক সমস্যা। গানবাজনা করে সংসার চালানো আকবরকে এখন অনাহারে, অর্ধাহারে, ধারদেনা করে সংসার চালাতে হচ্ছে। প্রথম রোজার দিন ঘরে কোনো চাল না থাকায় পাশের বাসা থেকে দুই কেজি চাল এনে খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন আকবরের স্ত্রী। এভাবে লকডাউনে আরও কত দিন থাকতে হয়, তার কোনো ঠিক নেই। কী হবে, তা ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না আকবর।
গেল বছরের শুরুর দিকে অসুস্থ হয়ে বেশ কয়েক দিন হাসপাতালে থাকতে হয় আকবরকে। তার অসুস্থতার খবর পৌঁছে যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। এরপর তার পরিবারকে ডেকে ২০ লাখ টাকা অনুদান দেন প্রধানমন্ত্রী। সেই টাকার মুনাফা হিসেবে তিন মাস পর পর ৪৯ হাজার টাকা ব্যাংক থেকে তোলেন আকবর। ওই টাকার ১৬ হাজার ৩০০ টাকায় চলত তার সংসার।
পরিবার নিয়ে আকবর ঢাকার মিরপুর ১৩ নম্বরে থাকেন। তার বড় মেয়ে আছিয়া আকবর অথৈ হারম্যান মাইনর স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। কথায় কথায় আকবর জানান, মিরপুরের যে বাড়িতে তিনি থাকেন, বিদ্যুৎ, গ্যাস বিলসহ মাসে তাদের ভাড়া দিতে হয় সাড়ে ১৩ হাজার, মেয়ের স্কুলের বেতন ২ হাজার ২০০ টাকা, সংসার খরচ ১০ হাজার টাকা, মেয়ের কোচিং ও তার ওষুধের খরচ ৭ হাজার। করোনার কারণে গানের অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় কোনো আয় নেই তার। আকবর বলেন, ‘মাসে দু-তিনটা অনুষ্ঠান করি। অনুষ্ঠানভেদে ১০ থেকে ১৫ বা ২০ হাজার টাকা সম্মানী পাই। সব সময় আয় তো আর এক রকম থাকে না। সংসার-ওষুধপত্র, মেয়ের খরচসহ আমাদের কোনো রকমে হয়ে যায়। দুই মাসের বেশি ঘরে বসা। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ অনুষ্ঠানে গান করেছি। গান না থাকলে তো আয়ও নাই। কীভাবে যে চলছি, তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন।’ সংসারের পাশাপাশি শরীর নিয়ে ভীষণ কষ্টে আছেন বলে জানালেন আকবর। গত বছরের আগস্ট মাসে চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যাওয়া হয়নি। এদিকে শরীরের অবস্থার অবনতিও হচ্ছে। আকবর বলেন, ‘শরীরে ফোসকা এমন হয়েছে, সারা রাত ঘুমাতে পারি না। ব্যাথায় ছটফট করতে থাকি। এদিকে আবার অভাব-অনটন শুরু হয়েছে।’
করোনার এই সময়ে পরিস্থিতি খারাপ দেখে স্ত্রীর কথায় পরিচিত দু-একজনের কাছে মুখ ফুটে সাহায্যের কথা বলেছিলেন আকবর। তিনি বলেন, ‘তাঁরা আশ্বাস দিয়েছেন, সাহায্য দেননি। পরে ফেসবুকে দেখি, তাঁরা রাস্তায় ত্রাণ বিতরণ করছেন। আমি স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে অভাবে আছি। তাঁরা আমাকে যদি কিছু সাহায্য ত্রাণ হিসেবেও দিত, তবু কয়েকটা দিন খেয়ে থাকতে পারতাম। ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করার না। শরীরের ফোসকার চেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণা বেশি।’
কয়েক দিন আগেও গান গেয়ে মঞ্চ মাতাতেন আকবর। কণ্ঠে তুলে নিতেন কিশোর কুমার, কুমার শানু, সৈয়দ আবদুল হাদীর জনপ্রিয় সব গান। গাইতেন নিজের গাওয়া শ্রোতাপ্রিয় কিছু গানও। এসব গানে শ্রোতারা মাতোয়ারা হতেন, শিল্পীর সঙ্গে মেলাতেন কণ্ঠ। কণ্ঠের জাদুতে দর্শকেরা ভাসতেন সীমাহীন আনন্দে। দর্শকের তুমুল করতালিতে আকবর হতেন অনুপ্রাণিত। দর্শকের প্রিয় সেই গায়কের দিন কাটছে অনাহারে, অর্ধাহারে, ধারদেনা করে। টাকার অভাবে ঠিকমতো ওষুধ কিনতে পারছেন না তিনি। ডায়াবেটিসের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় পুরো শরীরে ফোসকা পড়ে গেছে তাঁর।
আট বছর ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন আকবর। তিন বছর হলো তার শরীরে বাসা বেঁধেছে জন্ডিস, রক্তে প্রদাহসহ নানা রোগ। তাই আগের মতো এখন আর মঞ্চে গাইতে পারেন না। কিশোর কুমারের ‘একদিন পাখি উড়ে’ নতুন করে গেয়েছিলেন আকবর আলী গাজী। সবার কাছে তিনি আকবর নামে পরিচিত। হানিফ সংকেতের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে এই গান তাকে আলোচনায় নিয়ে আসে। এরপর ‘তোমার হাতপাখার বাতাসে’ গানটি দেশ-বিদেশের দর্শক-শ্রোতার কাছে তাকে পরিচিত করে তোলে। আলোচিত গায়কের চিকিৎসার করার মতো সামর্থ্যও নেই, করোনায় এখন যোগ হয়েছে পরিবার নিয়ে অসচ্ছল জীবন। গায়ক হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার আগে যশোরে রিকশা চালাতেন আকবর। খুলনার পাইকগাছায় জন্ম হলেও আকবরের বেড়ে ওঠা যশোরে। গান শেখা হয়নি। তবে আকবরের ভরাট কণ্ঠের কদর ছিলো যশোর শহরে। সে কারণে স্টেজ শো হলে ডাক পেতেন তিনি। ২০০৩ সালে যশোর এমএম কলেজের একটি অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন আকবর। বাগেরহাটের এক ব্যক্তি আকবরের গান শুনে মুগ্ধ হন। তিনি জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে চিঠি লেখেন আকবরকে নিয়ে। এরপর ইত্যাদি কর্তৃপক্ষ আকবরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ওই বছর ইত্যাদি অনুষ্ঠানে কিশোর কুমারের ‘একদিন পাখি উড়ে’ গানটি গেয়ে রাতারাতি পরিচিতি পেয়ে যান আকবর।