প্রাকৃতিক এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে ‘মা ও সšতান’ ……………… জালাল কবির

পৃথিবীতে সšতানের সঙ্গে ‘মা’ এর সম্পর্ক এবং বা¯তব গুরুত্ব যে কত অপরিসীম তা বোধ করি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।  চরম বা¯তবতার নিরীখে বিষয়টির কিছু  ব্যাখ্যা আমি দেবার চেষ্টা করবো। আশা করি প্রত্যেক পাঠক নিজ থেকে এর গভীরতাকে অনুধাবন করতে পারবেন। প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে পাখি যখন ডিম থেকে তার ছানা প্রসব করে তখন অধিকাংশ ‘মা’ পাখি জানে না, তার সঙ্গী কোথায়। একটি ছাগল, গাভী, কিংবা মাদী উট  যখন বাচ্চা প্রসব করে তখন সেই বাচ্চাটির দায়িত্ব প্রাকৃতিক ভাবেই মা প্রাণীর উপর বর্তে যায়। কারন তার বক্ষে থাকে দুধের ভা-ার। এভাবে পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাবো প্রত্যেকটি প্রাণীর ‘মা’ প্রাণীটি তার সšতানের একাই সব দায় দায়িত্ব পালন করছে। বাচ্চার আহার যোগাড়, বাচ্চাকে নিরাপদ রাখা সবকিছুই ‘মা’ কে করতে হয়। অবশ্যই কিছু প্রাণীদের মধ্যে ‘বাপ’ প্রাণীটি আংশিক দায়িত্ব পালন করে এবং এসব প্রাণী পৃথিবীতে সংখ্যায় অতি কম। যেমন বাঘ, সিংহ, হাতী, ভালুক, কুকুর ইত্যাদি।
হাস মুরগীর ছানা যখন চিলপাখি ছোঁ মেরে নিয়ে যায় তখন  ‘মা’ মুরগী তার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করে। প্রায় সময়ই মা নিজেই আহত হয়। অথচ  বাপ মোরগ তখন কোথায় থাকে ? তার কোনো পাত্তাই পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে বেশ কিছু ব্যতিক্রম দেখতে পাওয়া যায় শিম্পাঞ্জি, গরিলা, ওরাং ওটান, গ-ার, হনুমান, এবং বানর জাতীয় প্রাণীদের। আর সমুদ্রের মধ্যে তিমি, ডলফিন, শীল প্রভৃতি বৃহদাকার প্রাণীগুলোর মধ্যে। এই প্রাণীগুলোর মধ্যে যারা ‘বাপ’ প্রাণী হিসাবে নিজেদের মধ্যে চিহ্নিত হয়, তাদের অনেকেই বাচ্চার দায়িত্ব পালন করে। যেমন; মা প্রাণীটি আহার সন্ধান করতে গেলে ‘বাপ’ প্রাণীটি বাচ্চা পাহারা দেয় অর্থাৎ সঙ্গে থাকে। বাচ্চাকে বিপদ থেকে বাঁচাবার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। মা ও বাচ্চা যখন উভয়ে বিপদে পতিত হয় তখন বিশেষ ধরণের চিৎকারের ভাষা ব্যবহার করে ‘বাপ’ প্রাণীকে বিপদের সংবাদ জানিয়ে দেয়।  হায়েনা, বাদর, নেকড়ে বাঘ, শেয়াল, বন্য গরু, কাক, বাদুর, উড়ো হাস, ইত্যাদি প্রাণীগুলো দলবেধে থাকতে ভালোবাসে। পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে এর প্রধান কারণ হচ্ছে নিজেদের ও বাচ্চাদের নিরাপত্তার জন্যই ওরা দল বেধে থাকে। গরিলা, শিম্পাঞ্জি,ওরাং ওটান ও বানর শ্রেণীর প্রাণীগুলো মানুষের মতই বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে পারে এবং কোলে কাঁখে বুকে বা কাঁধে বহন করতে পারে। কুকুর বিড়াল হায়েনা ভালুক প্রভৃতি প্রাণীগুলো বাচ্চার ঘাড় কামড়ে ধরে বাচ্চাকে একস্থান থেকে অন্য নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়। এসব বা¯তব অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় আমরা মানুষজাতি হিসাবে আলাদা প্রাণী হলেও অন্যান্য প্রাণীদের আচরণের মধ্যে আমাদের বেশ একটা মিল বা সংযোগ রয়েছে।
মানুষের ভাষা এবং বুদ্ধি এই দুইটি গুণ বিদ্যমান থাকার কারণে আমরা সকল প্রাণী থেকে শ্রেষ্ঠ বা উত্তম হিসাবে নিজেদের বিবেচনা করি। আধুনিক  জীব বিজ্ঞানীগণ বা¯তব জ্ঞান পাওয়ার জন্য মানব শিশুকে জঙ্গলে প্রতিপালন করে দেখেছেন সেই শিশু বিভিন্ন রকম চিৎকার ও বানরের মত হাত পায়ের ব্যবহার ছাড়া তেমন কিছু আয়ত্ব করতে পারে না। তবে সে যা কিছু দেখে এবং শুনে তার কিছুটা সে স্মরন রাখতে পারে। এই আধুনিক যুগে শিশু এবং উঠতি বয়েসের মানব শিশু যখন হঠাৎ কোনো বিপদে পড়ে তখন তারা যে চিৎকার করে, সেই চিৎকার হুবহু অনেকটা শিম্পাঞ্জি, গরিলা বা বানর প্রাণীদের চিৎকারের মতই।
পাখিদের মধ্যে আমাদের অতি পরিচিত মোরগ, হাস, পায়রা প্রাণীগুলো বছর জুড়ে প্রজনন ক্ষমতায় সক্ষম। কিন্তু অধিকাংশ প্রজাতির পাখি এবং ¯তন্যপায়ী পশু বছরের কয়েকটি নির্দিষ্ট দিন ব্যতীত অন্যান্য সময়ে যৌনানুভুতি অনুভব করে না, কিন্তু মানুষ জাতির পুরুষেরা বছরের ৩৬৫ দিন এবং নারীরা প্রায় ৩০০দিন যৌনাভুতি অনুভব করে। অর্থাৎ তারা ইচ্ছে করলে যৌন মিলনে মিলিত হতে পারে। এটি প্রকৃতির এক বিশাল রহস্য। যে রহস্যের কারণ আজো মানুষ খুঁজে পায়নি। বিজ্ঞানীরা বলছেন হাজার হাজার বছরের ‘প্রাকৃতিক বিবর্তনের’ কারণে মানুষ জাতি এই শক্তি লাভ করেছে। ‘প্রাকৃতিক বিবর্তন’ হচ্ছে সৌরজগত এবং মহাবিশ্বের সঙ্গে পৃথিবীর একটি চুম্বক ও আলোকরশ্মির বন্ধন। যে বন্ধন অত্যšত রহস্যময়, যা লক্ষ লক্ষ বছরে পৃথিবীর তরু ও প্রাণী জগতে কার্যকরি হয়।  এই বন্ধনের প্রভাবে পৃথিবীতে মানুষ ও প্রাণীদের ‘জীনে’ এবং কখনও কখনও কোষ অনুতেও ‘মিউটেশান’ বা পরিবর্তন ঘটায়। বিষয়টি অতি ব্যাপক।  মহামতি চার্লস ডারউইন ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ মতবাদের মধ্যে এর আংশিক রহস্য উদঘাটন করেছেন। মানুষ জাতি প্রাকৃতিক ভাবে এই যৌনশক্তি লাভ করার কারণে পৃথিবীতে মানুষের সšতান উৎপাদন ক্ষমতা অন্যান্য সকল প্রাণীদের থেকে বেশি। তবে কীট পতঙ্গদের এই হিসাবের মধ্যে আনয়ন করলে পৃথিবীতে পিপড়া মশা মাছি ইত্যাদির সংখ্যাই বেশি আর সমুদ্রে ‘মা’ মাছের গর্ভে ডিম তথা পোনার মাছের সংখ্যাই বেশি।
যাইহোক আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল মানব জাতির সšতানের সঙ্গে মা এর বিষয়টি নিয়ে। সেই বিষয়টি এবারে আলোচনা করবো। উপরের আলোচনা থেকে আমরা বা¯তব অভিজ্ঞতায় দেখতে পাই ‘মা’ হচ্ছেন সšতানের বেঁচে থাকার শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল। আমরা প্রাকৃতিক ভাবে আরও দেখতে পাই মা এর সঙ্গে বাচ্চার সম্পর্ক যেমন রক্তের তেমনি অপরিসীম ¯েনহের। এই ¯েনহ মমতার বন্ধন এতই গভীর, এতই অদৃশ্য চুম্বকময় যে, উহার সীমা পরিসীমা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। আদিম যুগে যখন মানুষের ভাষা ও বুদ্ধির বিকাশ তেমন ঘটেনি তখন মানব সšতানের বাপ ছিল অনেকটা দায়িত্বহীন। এযুগের মত রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় কোনো আইনের বাধ্য বাধকতায় সে দায়ী ছিল না। সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা ও নৃতত্ত্ব বিদ্যার ইতিহাস থেকে আমরা এর সত্যতা পাই। সেই যুগে যখন তখন নারী সঙ্গম এবং পশু পাখি শিকার করা ছিল ‘বাপ’ নামে পরিচিত মানুষটির যৌবনের সবচেয়ে বড় ব্য¯ততা। যেমন করে ষাড় মোরগা ইত্যাদি প্রাণীগুলো তাদের সšতানের খবর জানে না।
প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ, খাদ্যের অভাব এবং অসুখ বিসুখে পথ্যের অভাবে অধিকাংশ মানব শিশু তখন মারা যেত। আর এই সšতান উৎপাদনের শুণ্যতা পুরণ করতো পুরুষ। নারী জাতিরাও সšতানের কামনায় এগিয়ে আসতো পুরুষের সান্নিধ্যে।  কারণ তখনও পৃথিবীর বহু স্থানে বস্ত্র তৈরি করতে মানুষ শিখেনি। অন্যান্য প্রাণীদের মতো যৌনকর্ম তখন পরিবারের বা সমাজের সবাই প্রকাশ্যে উপভোগ করতো। যার ফলে যৌন বিষয়টি মানুষ জাতির মধ্যে লজ্জা হিসাবে স্থান পায়নি। বিষয়টি প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক ভাবেই মানুষ গ্রহণ করতো। বিষয়টির সত্যতা জানার জন্য আমাদেরকে আর্কেওলজি কিংবা এনথ্রোপলজির (প্রতœতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ব) আওতায়  ব্রোঞ্জের যুগ বা লৌহের যুগে যেতে হবে না। এই বিংশ শতাব্দির দক্ষিন আমেরিকার আমাজনের গহীন জঙ্গলে এবং পাপুয়া নিউগিনির মত দেশের  জঙ্গলে  এখনও অনেক উপজাতি লোক বসবাস করছে। এছাড়া আফ্রিকার মালি, তাঞ্জানিয়া এবং এশিয়ার মায়ানমার ও থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে আদিম সভ্যতার নানাবিধ কালচার এখনও বিদ্যমান। রাষ্ট্রীয় অনুমতি, উপজাতি সর্দারের অনুমতি এবং দোভাষী ও পর্যটক সাংবাদিকের সহায়তায় এসব দেখা এবং জানা আজও সম্ভব।
ধীরে ধীরে  সময়ের সহস্রাব্দির স্রোতে (প্রায় দুই থেকে আড়াই লক্ষ বছর অতিক্রম শেষে) মানুষ আপন আপন বুদ্ধির জোরে ভাষা ও জীবন ধারণের জন্য চাষাবাদ সহ বহুমুখি পণ্যের উৎপাদন শুরু করে। মানুষ সময়ের ধাপে ধাপে অসভ্য থেকে আরও সভ্য হতে লাগলো। আদিম যুগের প্রচলিত বিশ্বাসের ধর্মগুলোর অনেকটাই বিলুপ্ত হতে থাকলো। আর সেই স্থান ধীরে ধীরে দখল করে নিলো নতুন নতুন ধর্ম। এভাবে পৃথিবীর বুক থেকে হাজার হাজার ধর্মের বিলুপ্তি ঘটেছে। ইতিহাসবিদরা নানাবিধ তথ্য যোগাড় করে প্রমান করেছেন যে মানুষ জাতির সভ্যের সুচনা হয় ‘নতুন পাথরের’ যুগ থেকে। অর্থাৎ আজকের সময়-সাল থেকে এগারো হাজার পাঁচশত বছর আগে। তারপর সভ্যতার নতুন যুগ হিসাবে আর্বিভাব হয় লৌহ যুগের।
সভ্যতার মাপকাটি হিসাবে কালের পরিপ্রেক্ষিতে সভ্য হিসাবে অধিকাংশ দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের দাবী হলো মানুষজাতির অবিস্মরণীয় উন্নতির শুরু হয় খ্রিষ্টপুর্ব তিনহাজার একশত সাল থেকে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার একশত চৌদ্দ বছর পুর্বে। (যা লৌহ যুগের অšর্তভুক্ত) তা শুরু হয় আজকের মিশর থেকে শুরু করে সিরিয়া,ইরাক ও ইরান পর্যšত।  ঐতিহাসিকগণ সময়ের বিবেচনায় এই সাম্রাজ্যকে ‘আপার ইজিপ্ট ও লোয়ার ইজিপ্ট দুই ভাগে ভাগ করেন। সর্বমোট  বিশটি ফেরাউন রাজবংশ এই রাজ্য শাসন করে। প্রথম ডাইনাষ্টি বা রাজবংশের রাজার নাম ছিল ‘হরআহা’ আর সর্বশেষ ডাইনাষ্টির খ্যাতিমান রাজা হচ্ছে ‘রামাসিস-দ্বিতীয়। এরপর যথাক্রমে লিবিয়া, পারস্য (পারসিক) গ্রীক বংশউদ্ভোত ফেরাউনরা মিলে ১১টি রাজবংশ মিশর সাম্রাজ্য শাসন করে। তাদের মধ্যে সর্বশেষ ডাইনাষ্টি হচ্ছে ‘টলেমি’ এবং তাদের রাজত্ব শেষ হয় খ্রিষ্টপুর্ব ত্রিশ সালে। এরপর এই সাম্রাজ্য রোমের অধীনে চলে যায়। এই পৃথিবীর বুকে সভ্যতার এত পরিবর্তন  হয়েছে যে এটা অনুমান করা কিংবা বিশ্বাস করা অত্যšত কঠিন।
তা সত্ত্বেও  সšতানের প্রতি মায়ের ¯েনহ মমতার কোনো ঘাটতি আজো হয়নি। তবে দায়িত্ব থেকে পলায়নপর বাবারা পেয়ে গেছেন অধিক দায়িত্ব। আর এই দায়িত্বকে মেনে নেবার জন্য যারা প্রয়োগ ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করেছে তারা হলেন বিভিন্ন সময়ের প্রজা হিতৈষী রাজাগণ আর বিভিন্ন ধর্মের প্রবর্তক ও প্রচারকগণ। তাই আজকের সভ্যতায় এসে আমরা বিয়ের মাধ্যমে মনের আবেগ ও দৈহিক চাহিদ মেটাই এবং পরিবার গড়ে তুলি। কোনো কোনো সমাজে বন্ধুত্ত্ব ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ  হয়ে নিজেদের রুচি মাফিক পরিবার গড়ে তুলি। অর্থনৈতিক স্বচ্চলতা আর রাষ্ট্রীয় সামাজিক অবস্থার উপরে এক এক সমাজে এক একধরণের ধর্মীয় বিধি নিষেধ স্থাপিত হওয়াতে নারী ও পুরুষরা তাদের ব্যক্তিস্বাধীতার কিছু কিছু বিষয় হারিয়ে ফেলেছে। তা সত্বেও সবাই নিজ নিজ সšতানকে পৃথিবীর যে কোনো কিছুর চেয়েও বেশি ভালোবাসে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More