কবি শহীদ কাদরী আর নেই
মাথাভাঙ্গা মনিটর: তোমাকে অভিবাদনের কবি আর নেই। চলে গেলেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কবি শহীদ কাদরী। দেশকে যিনি ‘প্রিয়তমা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। দুঃখিনী বাংলাকে যে কবি অভয় দিয়ে লিখেছিলেন- ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা ভয় নেই, এমন ব্যবস্থা করবো…।’ কবিপত্নী নীরা কাদরী জানিয়েছেন নিউইয়র্কের নর্থ শোর বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে গতকাল রোববার বাংলাদেশ সময় বিকাল ৫টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহে…..রাজেউন)। কবির বয়স হয়েছিলো ৭৪ বছর। উচ্চ রক্তচাপ এবং জ্বর নিয়ে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় সাত দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি।
দেশকে প্রিয়তমা বলে সম্বোধন করা, পরে জাতির জনকের হত্যাকাণ্ড কি কাঁদিয়েছিলো তাকে! বঙ্গবন্ধুর হত্যা নিয়ে লিখেছিলেন কবিতা। তার মৃত্যুতে দেশের শিল্প-সাহিত্য জগতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
শহীদ কাদরীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বাণী দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার মৃত্যুতে আধুনিক বাংলা কবিতা এক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে হারাল। শোক বার্তায় শহীদ কাদরীর ‘হন্তারকের প্রতি’ কবিতাটিও উদ্ধৃতি করেন প্রধানমন্ত্রী। …বাঘ কিংবা ভালুকের মতো নয়,/বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা হাঙরের দল নয় / না, কোনো উপমায় তাদের গ্রেফতার করা যাবে না/ তাদের পরনে ছিলো ইউনিফর্ম/ বুট, সৈনিকের টুপি,/ বঙ্গবন্ধুর সাথে তাদের কথাও হয়েছিলো,/তারা ব্যবহার করেছিলো/ এক্কেবারে খাঁটি বাঙালির মতো/ বাংলা ভাষা। অস্বীকার করার উপায় নেই ওরা মানুষের মতো/ দেখতে, এবং ওরা মানুষই/ওরা বাংলা মানুষ/ এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো কথা আমি আর শুনব না কোনোদিন।
এদিকে শহীদ কাদরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এ ছাড়া বাংলা একাডেমি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান শোক প্রকাশ করে বাণী দিয়েছে। উত্তরাধিকার, তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা এবং কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই মাত্র এই তিনটি কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন তার। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে কিন্তু পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রে। কবি যখন বাংলাদেশে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, ঠিক তখনই সবকিছু ছেড়ে পাড়ি জমালেন ইউরোপে। ইউরোপের ইংল্যান্ড, জার্মানি ঘুরে আমেরিকায় থিতু হন। যেন স্বেচ্ছা বন্দিত্ব। কিন্তু কেন এই বন্দিত্ব? এই উত্তর তার জীবিত অবস্থায় সবসময় পাঠকের মনে গুমরে ফিরেছে, মেলেনি উত্তর।
‘আমি করাত-কলের শব্দ শুনে মানুষ। আমি জুতোর ভেতর, মোজার ভেতর সেঁধিয়ে যাওয়া মানুষ।’ (এবার আমি) শহীদ কাদরী আধুনিক নগর ভাবনার কবি। তার কবিতার শরীরে নাগরিক ব্যস্ততা, মগ্নতা আর ভীরুতার ছাপ। কবির জন্ম, বেড়ে ওঠা, যৌবনের সমস্ত আয়োজনই ছিলো শহরকেন্দ্রিক। আর সে কারণেই হয়তো তার কবিতায় শহর এসেছে, শহরের মানুষের ভাবনা, মানসিক নানা পর্যায় এসেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
শহীদ কাদরীর মৃত্যুতে তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কবি বেলাল চৌধুরী বলেন, আমার বন্ধু ছিল সে। খুবই শক্তিমান কবি। তার এ চলে যাওয়া আমার জন্য বড় ক্ষতি। আমি এই মুহূর্তে আর কিছুই বলতে পারব না।
জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ জানান, গতকাল স্থানীয় সময় সকাল ৭টায় নিউইয়র্কের নর্থ শোর বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি জানান, কবিপত্নী নীরা কাদরী তাকে এ তথ্য জানিয়ে দ্রততম সময়ের মধ্যে তার মরদেহ বাংলাদেশ আনা হবে। কবিপত্নী মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তার দাফনের ইচ্ছা পোষণ করেছেন। বাংলাদেশে মরদেহ আসার পর তাকে শহীদ মিনারে জাতির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হবে বলে জানিয়েছেন মুহাম্মদ সামাদ।
গত ১৪ আগস্ট প্রবাসী কবি শহীদ কাদরী ৭৪ বছরে পদার্পণ করেন। সেদিন নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় কবির বাসভবনে বিকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ভক্ত-অনুরাগীরা কবিকে ফুল দিয়ে, গান গেয়ে ভালোবাসায় সিক্ত করেন। এর এক সপ্তাহ পর গত ২১ আগস্ট স্থানীয় সময় রাত ৩টা ১৫ মিনিটে নিউইয়র্কের নর্থ শোর হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয় তাকে। এর আগের দিন থেকেই জ্যামাইকার বাসায় কবির শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তিনি উচ্চ রক্তচাপ এবং জ্বরে ভুগছিলেন।
প্রবাসী কবি শহীদ কাদরী ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট কোলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার পর তার পরিবার স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন। ১৪ বছর বয়সে শহীদ কাদরীর প্রথম কবিতা ‘এই শীতে’ বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কাকতালীয়ভাবে সেদিনই তার মা মারা যান। ত্যুর খবর শুনে তিনি হাসপাতালে যাচ্ছেন।