রিকশার প্যাডেলেই ৪২ বছর আটকে আছে সংগ্রামী আসলাম
আফজালুল হক: জন্মের পর থেকেই বাঁ হাত ও বাঁ পা অস্বভাবিক। স্পষ্টভাবে কথাও বলতে পারেন না। স্বাভাবিকভাবে হাঁটও অসম্ভব। কিন্তু দমে যাননি জীবনযুদ্ধে। ৪২ বছর রিকশা চালিয়ে ধরে রেখেছেন সংসারের হাল। নানা প্রতিবন্ধকতা আর চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এক হাত দিয়ে রিকশা চালিয়ে জীবনসংগ্রামে জয়ী হয়েছেন তিনি। মা-বাবার একমাত্র ছেলে আসলাম উদ্দিন (৫৪)। স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। চার সদস্যের পরিবারে উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তি তিনি। অভাব যেখানে তার নিত্যদিনের সঙ্গী। তারপরও দমে যাননি। দুই ছেলে-মেয়েকে বড় করে বিয়ে দিয়েছেন।
১৯৬৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মুসলিমপাড়ায় এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আসলাম উদ্দিন। দিনমজুর বাবা আহম্মদ ম-লের (মৃত) এক মেয়ে ও এক ছেলে। আসলাম উদ্দিন ছোট। জন্মের পর থেকে আসলাম শারীরিক প্রতিবন্ধী। স্বাভাবিকভাবে কথাও বলতে পারেন না। আসলামের বাবার একার আয়ে পরিবার চালানো কঠিন হয়ে পড়ত। আসলামের বয়স যখন ১২ বছর, তখন তার বাবা মারা যান। সংসারে দেখা দেয় চরম অভাব। কিন্তু যে সময় আসলামের স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল, সে সময় দুবেলা-দুমুঠো খাবার জোটানোর জন্য হাতে তুলে নেন রিকশা। যেন প্যাডেলেই আটকে যায় তার জীবন। পৌর এলাকার হাজরাহাটি গ্রামের স্কুলপাড়ার মৃত যাদু ম-লের মেয়ে শিল্পী খাতুনের সঙ্গে আসলাম বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। তাদের কোলজুড়ে আসে একটি মেয়ে ও একটি ছেলে। প্রাইমারি স্কুলের গ-ি পেরিয়েই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে মেয়ে জোসনা খাতুনকে (২৮)। ছেলে সিদ্দীক আহমেদ (২১)। তিনিও কোনো রকম প্রাইমারির গ-ি পেরিয়েছেন। বর্তমানে একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সাত হাজার টাকা বেতনে কাজ করেন। সাত মাস আগে ছেলে সিদ্দীক আহমেদকে বিয়ে দিয়েছেন আসলাম।
সরজমিনে আসলাম উদ্দিনের বাড়িতে দেখা যায়, বাড়িতে ঢোকার আগেই টিনের চালের একটি রান্নাঘর। সেখানে রান্না করছেন আসলাম উদ্দিনের স্ত্রী শিল্পী খাতুন। তাকে সহযোগিতা করছেন তার পুত্রবধূ। মেয়ে জোসনা খাতুন বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। দুই রুমবিশিষ্ট পাকা ঘর। ওপরে চিটের ছাপড়া। এখানেই আসলাম উদ্দিনের স্ত্রী, ছেলে ও পুত্রবধূকে নিয়ে বসবাস। ঘরের সামনে ছোট্ট একটি ঘরে কয়েকটি ছাগল পোষেন। আসলাম উদ্দিনের প্রতিবেশীরা সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি আসলাম উদ্দিনকে। জীবনযুদ্ধে হার না মানা এক পুরুষ তিনি। দারিদ্র্য আর শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করেই বেঁচে আছেন। সব বাধাকে তুচ্ছ করে এগিয়ে চলার এই উদাহরণ এলাকাবাসীর কাছেও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তবে বয়স বাড়ছে আসলাম উদ্দিনের। তাই দুশ্চিন্তা বাড়ছে পরিবারের অন্য সদস্যদেরও। তারা আরও বলেন, আসলাম উদ্দিন খুব সরল মনের মানুষ। সবার সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করেন। কারও সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব নেই। তিনি সবার কাছে প্রিয় একজন ব্যক্তি। আমরা সবাই যতটুকু পারি, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই। আসলাম উদ্দিনের স্ত্রী শিল্পী খাতুন বলেন, আমার শ্বশুরের রেখে যাওয়া চার কাঠা জমির ওপর কোনো রকমে বসবাস করছি। এ ছাড়া আর কিছুই নেই আমাদের। আমার স্বামী একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। ২০ বছর আগে উপজেলা প্রশাসন থেকে একটি রিকশা দেয় তাকে। এই রিকশা চালিয়ে যা আয় হয়, তা-ই দিয়েই চলে সংসার। পাশাপাশি সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী ভাতাও পাচ্ছেন। কোনো রকম টেনেটুনে সংসার চলে যাচ্ছে।
আসলাম উদ্দিনের মেয়ে জোসনা খাতুন বলেন, ছোট থেকেই দেখে আসছি আমার বাবা শারীরিক প্রতিবন্ধী। সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে রিকশা চালিয়ে আমার ও আমার ভাইকে মানুষ করেছেন। আমাদের বিয়েও দিয়েছেন। বর্তমানে সব দ্রব্যমূল্যের দাম আকাশছোঁয়া হওয়ায় সংসারটা খুব ভালোভাবে চলছে না। আমরা চাই সরকারিভাবে বা সমাজের সবাই একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিক। বাবার বয়স বাড়ছে। তাই সব সময় চিন্তা হয় তার জন্য। তার ছেলে সিদ্দীক আহমেদ বলেন, আমার বাবা সব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমাদের মানুষ করেছেন। আবার বিয়েও দিয়েছেন। আমি আমার স্ত্রীকে নিয়েই মা-বাবার সঙ্গে থাকি। বাবার বয়স হয়েছে। এখন রিকশা চালাতেও কষ্ট হয়। অর্ধেক বেলা রিকশা চালিয়ে যা আয় হয়, তা দিয়ে কোনো রকম চলে। আমিও একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। সেখান থেকে যা উপার্জন হয়, তা দিয়ে বাবাকে সহযোগিতা করি।
নিজের কষ্টের কথা আসলাম উদ্দিন বলেন, দুই ছেলে-মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। আমার শরীর আর আগের মতো ঠিক নেই। শরীরে আগের মতো জোর পাই না। তবু কারোর কাছে হাত না পেতে রিকশা চালিয়ে যা আয় হয়, তা-ই দিয়েই কোনো রকম চলে। ১৯৭৯ সালে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার তৎকালীন চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম পিনু একটি রিকশা কিনে দেন। এই রিকশা চালিয়ে ছেলে-মেয়েদের বড় করে বিয়ে দিয়েছি। প্যাডেল মেরে রিকশা চালাতে কষ্ট হচ্ছে দেখে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উপজেলা প্রশাসন একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা দেয়। তিনি আরও বলেন, আমি আর এখন রিকশা চালাতে পারি না। অর্ধেক বেলা রিকশা চালাই। এখন রিকশা চালালে দম আটকে যায় মাঝেমধ্যে। সরকার থেকে তিন মাস পরপর ২ হাজার ২৫০ টাকা আমাকে প্রতিবন্ধী ভাতা দিচ্ছে। এতে কি আর সব হয়? প্রতিদিনই ৪০ থেকে ৫০ টাকার ওষুধ খেতে হয়। সরকারিভাবে কোনো সহযোগিতা হলে ভালো হতো।
চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার ৮ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, আসলাম উদ্দিন খুব ভালো মনের মানুষ। তিনি একজন সৎ-নিষ্ঠাবান ও শারীরিক প্রতিবন্ধিতা পেরিয়েও কর্ম করে সংসার চালাচ্ছেন। তিনি রিকশা চালিয়ে ছেলে-মেয়েদের মানুষ করে বিয়েও দিয়েছেন। তার এই সংগ্রামী জীবনকে স্যালুট জানাই। তিনি সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী ভাতা পান। এখনকার অবস্থা বিবেচনা করলে এ টাকায় কিছুই হয় না। তার ওষুধ খরচেই চলে যায় প্রতিদিন ৫০ টাকা। সরকারিভাবে তাকে আরও সুবিধা দেওয়া হবে। এ ছাড়া এলাকার সবার সহযোগিতাও দরকার।