চুয়াডাঙ্গায় করোনা সংক্রমিত হয়ে আরও ৪ জনসহ উপসর্গ নিয়ে মারা গেলেন ১১ জন

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গায় করোনা ভাইরাস সংক্রমিদের মধ্যে আরও ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরও ৭ জন। সোমবার ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত এদের মৃত্যু হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের হিসেবে চুয়াডাঙ্গায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯১ জন। উপসর্গ নিয়ে মৃতের সংখ্যা চুয়াডাঙ্গায় দুদিনে ১৭ জন। সোমবার নতুন ৯৯ জন করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। ৩০৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে এ সংখ্যক রোগী শনাক্ত হয়েছে বলে জানানো হলেও শুধুমাত্র র‌্যাপিড এন্টিজেন পরীক্ষায় ৯৯ জন শনাক্ত হয়েছে। বাকিদের নমুনা পুনরায় পরীক্ষার জন্য পিসিআর ল্যাবে প্রেরন করা হয়েছে। যদিও পিসিআর ল্যাব থেকে যথাসময়ে পরীক্ষার রিপোর্ট না পাওয়ার কারণে ভাইরাস সংক্রমণ রোধের পথে অনেকটাই অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এছাড়া করোনা ভাইরাস সংক্রমিত শনাক্তের পর বাড়িতে আইসোলেশনে থাকা অনেকেই নিজেই নিজের চিকিৎসা নেয়ার জন্য ছুটছেন ওষুধের দোকানে কিম্বা চিকিৎসকের চেম্বারে। এ থেকেই সংক্রমণ বাড়ছে। সোমবার স্বাস্থ্য বিভাগ নতুন ২৬৪ জনের নমুনা সংগ্রহ করেছে।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, দামুড়হুদা উপজেলার উজিরপুর গ্রামের মৃত মিরাজুল ইসলামের ছেলে আকবর আলী কিছুদিন আগে সর্দি কাশিতে আক্রান্ত হন। তার নমুনা পরীক্ষা করে কোভিড-১৯ পজিটিব হয়। বাড়িতেই ছিলেন তিনি। রোববার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ওইদিন সকাল ৮টার দিকে সদর হাসপাতালের রেডজোনে নিয়ে ভর্তি করা হয় তাকে। একদিন পর গতকাল সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মারা যান ৪৪ বছর বয়সী আকবর আলী। একই উপজেলার মাদরাসাপাড়ার আজাহার আলীর স্ত্রী ফাতেমা খাতুন সর্দি কাশি জ¦রে আক্রান্ত হন। তিনিও নমুনা পরীক্ষা করেন। কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়। নিজ বাড়িতেই তিনি আইসোলেশনে ছিলেন। শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে গতকাল সোমবার সকাল ৯টার দিকে তাকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। ভর্তি করা হয় রেডজোনে। গতরাত পৌনে ১১টার দিতে তিনি মারা যান। গতকাল সোমবার ভোরে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যান আলমডাঙ্গা উপজেলার বড় গাংনীর হায়দার আলী নামের একজন। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে সর্দি কাশি জ¦রে ভুগছিলেন। রোববার রাতে শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে মধ্যরাতে নেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে। তাকে হাসপাতালের হলুদ জোনে ভর্তি করা হয়। ঘণ্টাখানেকের মাথায় রাত ৪টা ৫ মিনিটে মারা যান ৭২ বছর বয়সী হায়দার। তিনি মৃত আাইজউদ্দীনের ছেলে। একই উপজেলার চক হারদীর শওকত ম-লের ছেলে ফকির মোহাম্মদ সম্প্রতি সর্দি কাশি জ¦রে আক্রন্ত হন। তিনি নমুনা দিয়ে পরীক্ষা করান। কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়। বাড়িতেই আইসোলেশনে ছিলেন। সোমবার সকাল থেকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। বাড়ে শ্বাসকষ্ট কষ্ট। দুপুরে নেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে। রেডজোনে ভর্তিও করা হয়। সোয়া ২টার দিকে মারা যান ৮০ বছর বয়সী ফকির মোহাম্মদ। তার মৃতদেহ স্বাস্থ্য বিধি মেনে দাফনের নির্দেশনা দেয়া হয়। এছাড়াও চুয়াডাঙ্গা শহরতলী দৌলাতদিয়াড়ের শফি উদ্দীনের ছেলে টিটু সোমবার বিকেলে মারা যান। সদর হাসপাতালে বিকেল ৩টার দিকে মৃত্যু হয়। তিনিও করোনা উপসর্গে ভুগছিলেন। আলমডাঙ্গা ব্যুরো জানিয়েছে, গতকাল সোমবারেও আলমডাঙ্গায় করোনার উপসর্গ নিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৩ জন জনের মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আলমডাঙ্গা পৌর এলাকার গোবিন্দপুর গ্রামের মৃত ভোলা মন্ডলের ছেলে আরজেত আলী (৬৫) দিন ১৫ আগে অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। তিনি সর্দিজ্বর ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। সোমবার সকালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বেলা ১১টায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাকে গোবিন্দপুরের জান্নাতুল মাওয়া কবরস্থানে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়। অন্যদিকে, আলমডাঙ্গা উপজেলার প্রাগপুর গ্রামের মৃত মোহাম্মদ গাইনের ছেলে পল্লী চিকিৎসক বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিম উদ্দীন (৬৭) গতকাল সোমবার দুপুরে মৃত্যুবরণ করেছেন। পরিবার ও গ্রামসূত্রে জানা গেছে, গত ৭/৮ দিন পূর্বে তিনি সর্দিজ্বর ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হন। তিনি নিজেই গ্রাম্য চিকিৎসক ছিলেন, নিজ বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। গতকাল সোমবার তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে হারদী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়ার পথে দুপুর ২টার দিকে তিনি মারা যান। আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা শেষে লাশ দাফন করা হবে। এছাড়া আলমডাঙ্গা পৌর এলাকার গোবিন্দপুর গ্রামেরর মীর মিন্টুর স্ত্রী নাসরিন নাহার (৪০) মারা গেছেন। তিনিও সর্দি কাশি গায়ে বেথাসহ জ¦রে ভুগছিরেন। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে রাত সাড়ে ৯টার দিকে আলমডাঙ্গার ফাতেমা ক্লিনিকে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে সর্দিজ্বর ও পরিবর্তিতে টাইফাইডে ভূগছিলেন। তাছাড়া ডায়রিয়াও আক্রান্ত ছিলেন। ফাতেমা ক্লিনিকের মালিক মঞ্জু আলী জানান, নাসরিন নাহারের করোনা পরীক্ষা করা হয়নি। তবে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেলেন বলেই মনে হচ্ছে। এদিকে জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছে, জীবননগরে গতকাল সোমবার করোনা আক্রান্ত হয়ে রিজিয়া খাতুন (৭০) নামে এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। মৃত রিজিয়া খাতুন মনোহরপুর গ্রামের মৃত মহিউদ্দিনের স্ত্রী। জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. হেদায়েত বিন সেতু জানান, রিজিয়া খাতুন সপ্তাহখানেক ধরে শর্দি, কাশি ও জ্বরে ভুগছিলেন। এক পর্যায়ে রিজিয়া খাতুনের তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হলে সোমবার বেলা ১১ টার দিকে জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে ভর্তি করান তার নিকটজনেরা। এ সময় অ্যান্টিজেন টেস্টে তার করোনা পজিটিভ আসে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করার আধা ঘন্টার মাথায় মারা যান রিজিয়া খাতুন। এছাড়াও জীবননগর পৌর শহরের নারানপুর এলাকার হাফিজুল ইসলামের স্ত্রী বিউটি খাতুনের (৩৯) করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সোমবার বেলা ১২ টার দিকে নিজ বাড়িতেই তার মৃত্যু হয়। বিউটি খাতুন গত ৭-৮ দিন ধরে শর্দি, কাশি ও জ্বরে ভুগছিলেন। গতকাল সোমবার দুপুরে হঠাৎ তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হবার কিছুক্ষণ পরেই তার মৃত্যু হয়। অথচ না করা হয়েছে করোনা পরীক্ষা, না মানা হয়েছে স্বাস্থ্য বিধি।
এদিকে সোমবার চুয়াডাঙ্গা জেলায় নতুন ৯৯ জন করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে মোট শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩২৬৬ জন। সোমবার ১১ জন সুস্থ হেেছন। এ নিয়ে মোট সুস্থ হয়েছেন ২১৭৩ জন। সক্রিয় রোগী রয়েছে ৯৯২ জন। এর মধ্যে ৬১ জন হাসপাতালে, ৯৩১ জন নিজ নিজ বাড়িতে আইসোলেশনে রয়েছেন। এছাড়াও অর্ধশতাধীক রোগী রয়েছে সদর হাসপাতালের হলুদ জোনে। সোমবার শনাক্তকৃত ৯৯ জনের মধ্যে সদর উপজেলার ৩৭ জন, দামুড়হুদার ১৩ জন, আলমডাঙ্গা উপজেলার ১৩ জন ও জীবননগর উপজেলার ৩৬ জন। সদর উপজেলার ৩৪ জনের মধ্যে চক্ষু হাসপাতাল পাড়ার ৪ জন, গুলশানপাড়ায় দুজন, কলেজপাড়ার দুজন, রেলপাড়ায় ৩ জন, মাঝেরপাড়ায় ২ জন, বাগানপাড়ায় ৩ জন, ভা-ারদহে ২ জন, হাজরাহাটী ২ জন, সরোজগঞ্জে ৩ জন, কাশপাড়ায় ২ জন ও ডিহি কৃষ্ণপুরে ২ জন করে রোগী শনাক্ত হয়েছে। সোমবার একজন করে রোগী শনাক্ত হয়েছে হাসপাতালপাড়া, সিনেমা হলপাড়া, মুক্তিপাড়া, পলাশপাড়া, বনানীপাড়া, ডিজিটাল মোড়, সাদেক আলী মল্লিকপাড়া, কুন্দিপুর, পুলিশ লাইনে, দৌলাতদিয়াড় গ্রামে ও মহল্লায়। দামুড়হুদা উপজেলার ১৩ জনের মধ্যে দর্শনায় ৬ জন। ৬ জনের মধ্যে ৪ জনের ঠিকানা দেয়া রয়েছে শুধুমাত্র দর্শনা। ঈশ^রচন্দ্রপুরের ১ জন, লোকনাথপুরে ১ জন ও বড় শলুয়ার ১ জন। বড় শলুয়া সদর উপজেলার মধ্যে হলেও রোগীর ঠিকানা দর্শনা হিসেবে দেয়া রয়েছে। দামুড়হুদা উপজেলা সদরে ৩ জন, ভোগিরথপুর ১জন, মুক্তারপুর ১ জন, দুধপাথিলায় ১ জন। আলমডাঙ্গা উপজেলায় ১৩ জনের মধ্যে হারদী ২ জন, ওসমানপুরে ২ জন, আলমডাঙ্গা শহরের ১ জন, স্টেশনপাড়ার ১ জন, গোবিন্দপুরের ১ জন, মোহাম্মদপুরের ১ জন, নওদাপাড়ায় ১ জন, নগরবোয়ালিয়ায় ১ জন, পুলতাডাঙ্গায় ১ জন, আসমানখালী ১ জন, জেহালায় ১ জন। জীবননগর উপজেলার ৩৬ জনের মধ্যে জীবননগর দৌলতগঞ্জে ৬ জন, সিংনগরে ৫ জন, সন্তোষপুরে ২ জন, রাজনগরে ২ জন, লক্ষ্মীপুরে ২ জন, হাসাদহে ২ জন, কাজীপাড়ায় ২ জন, ধোপাখালী দুজন, মহানগরপাড়ায় ২ জন করে রোগী শনাক্ত হয়েছে। সোমবার ১ জন করে রোগী যেসব এলাকায় শনাক্ত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে কোর্টপাড়া, পল্লিবিদ্যুত অফিস, মনোহরপুর, আন্দুলবাড়িয়া, সুবলপুর, কাশিপুর, পুরাতন তেতুলিয়া, গুড়দাহ, সুটিয়া, হরিহরনগর, কাটাপোলে।
চুয়াডাঙ্গায় কঠোর লকডাউন চলছে। এরপরও সংক্রমণ বাড়ছে। শুধু শহরে নয়, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়াছে মারণ ব্যাধি করোনা ভাইরাস। বেশ কিছু এলাকায় ঘরে ঘরে সর্দি কাশি জ¦র, গায়ে ব্যাথা, বমি, গলায় ব্যাথাসহ নানা সমস্যা নিয়ে ভুগলেও তাদের অনেকেই করোনা পরীক্ষা করাচ্ছেন না। নিজের মতো নিজ বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। এধরণের রোগীদের মধ্যে যাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে, শ^স কষ্ট বাড়ছে তখনই নেয়া হচ্ছে হাসপাতালে। উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করার পর যারা মারা যাচ্ছেন তাদের কারো করো নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে বটে, তার আগে এসব পরিবার থেকে ছড়াচ্ছে গণহারে। শুধু তাই নয়, করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হওয়ার পর যারা নিজ নিজ বাড়িতে আইসোলেশনে রয়েছেন তাদের অনেকেরই প্রকাশ্যে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে। অথচ স্থানীয়ভাবে গঠিত কমিটি এবং স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠ পর্যায়ে কর্মরতদের এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখা যেমন কর্তব্যের অংশ তেমনই আক্রান্ত ব্যক্তির কিছু প্রয়োজন হলে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে জানানোর কথা। অসচেতনতার কারণে অনেকেই তা না করে বের হচ্ছেন বাইরে। গতকাল সোমবার সন্ধ্যার দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল এলাকার একটি ফার্মেসিতে বসে থাকা এক ব্যাক্তিকে দেখে জানতে চান স্বয়ং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এ সময় ওই ব্যক্তি জানান, তিনি করোনা আক্রান্ত রোগী। চিকিৎসা নিতে এবং ওষুধ কেনার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোয়াটার থেকে হাসপাতাল এলাকায় এসেছেন। তাকে ম্যাজিস্ট্রেট সতর্ক করে বাড়ি পাঠান। তিনি দীর্ঘশ^াস ছেড়ে বলেন, মানুষ দায়িত্বশীল না হলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সত্যিই কঠিন।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More