কুমিল্লায় গভীররাতে বাড়ি থেকে যৌথবাহিনীর হাতে আটক যুবদল নেতা মো. তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনার ব্যাখ্যা কী? কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে, কিন্তু সেই আইনি পদক্ষেপের নামে তারা বেআইনি কাজ করতে পারে না।
তৌহিদুলের পরিবারের সদস্যদের দাবি, ভুয়া তথ্যের ভিত্তিতে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা এসে অবৈধ অস্ত্রের সন্ধান করেন এবং অস্ত্র না পেয়ে তাকে অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করেছেন। আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তৌহিদুলকে আটক করার কথা বলা হয়েছে। যদি সেটা সত্যও হয়, আটকের কয়েক ঘণ্টা পর একজন সুস্থ-সবল মানুষ কেন লাশ হয়ে যাবেন? তৌহিদুলের পেট, বুক, পিঠ, পা, গলাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে নির্যাতনের চিহ্ন ছিলো।
কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোহাম্মদ সাইফুল মালিক বলেন, গত শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে থানা-পুলিশকে বলা হয় তৌহিদুল ইসলামকে নেয়ার জন্য। যখন পুলিশের কাছে তৌহিদুলকে হস্তান্তর করা হয়, তখন তিনি অচেতন অবস্থায় ছিলেন। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
উল্লেখ্য, অন্তর্র্বতী সরকারের আমলে এটাই নিরাপত্তা হেফাজতে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা নয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ২১ জন। এর মধ্যে অন্তর্র্বতী সরকারের আমলে বিভিন্ন সরকারি বাহিনীর হেফাজতে ও ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যার শিকার হয়েছেন ১২ জন।
যৌথ বাহিনীর হেফাজতে তৌহিদুলের মৃত্যুর প্রতিবাদে এলাকাবাসী মানববন্ধন করেছেন। পুলিশ বলেছে, তৌহিদুলের মৃত্যু নিয়ে পরিবারের কোনো অভিযোগ নেই। অথচ তৌহিদুলের পরিবার বলছে, নির্যাতনের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। তার চার সন্তান বাবাহারা হয়েছে।
একজন মানুষ বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে বাড়ি এসে যৌথ বাহিনীর নির্যাতনে মারা যাবেন, এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় দৃষ্টান্ত। এটি আইনের শাসনপরিপন্থী ঘটনা। অতীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেআইনি কর্মকা-কে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছিল বলে এসব বাহিনীর সদস্যরা আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের বিদায় নেওয়ার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটবে?
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পক্ষ থেকে ঘটনাকে দুঃখজনক ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা হিসেবে অভিহিত করে সংশ্লিষ্ট সেনাক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডারকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানানো হয়। মৃত্যুর সঠিক কারণ উদ্ঘাটনের জন্য উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সেনা আইন অনুযায়ী যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো আরেক বিবৃতিতে জানানো হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে কুমিল্লায় যুবদল নেতা মো. তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনার দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। ঘটনা তদন্তে তদন্ত কমিটি গঠনের কথাও জানানো হয় বিবৃতিতে।
আমরা মনে করি, তদন্ত কমিটি তখনই বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে, যখন তারা তৌহিদুলের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে এবং দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে পারবে। অতীতে এ ধরনের তদন্ত কমিটি সত্য উদ্ঘাটনের চেয়ে উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপাতেই সচেষ্ট ছিল। আশা করি, এর পুনরাবৃত্তি হবে না।
ন্যায়বিচারই পারে যেকোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে। তৌহিদুলের মৃত্যুর সঠিক তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করে ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা প্রয়োজন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে বিচার দাবি করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশের নাগরিকেরা আর দেখতে চান না।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.