চার বছর আগে রাজধানীতে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সারা দেশে সড়ক আন্দোলনের সূচনা হয়। সড়কে চলা চরম বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে তা ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষোভের বিস্ফোরণ। সরকার ওই সময় কৌশলে আন্দোলন দমন করলেও আন্দোলনকারীদের ৯ দফা দাবি কাগজ কলমে রয়ে গেছে। কিছু ক্ষেত্রে সড়ক ব্যবস্থাপনায় আরো অবনতি হয়েছে। সম্প্রতি চার বছর পূর্তি উপলক্ষে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ আবারো বিক্ষোভ করেছে। তাদের ওপর পরিচালিত হেলমেট বাহিনীর হামলার বিচার চেয়েছে। কিন্তু এবার সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর মূল দাবিটি আর করতে পারেনি।
২০১৮ সালের ৩১ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে রাস্তায় চাপা দেয় বেপরোয়া গতিতে চলা যাত্রীবাহী একটি বাস। এর জেরে সারা দেশে শিক্ষার্থীরা ফুঁসে ওঠে। গড়ে ওঠে সড়ক আন্দোলন। তখন আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয় ক্ষমতাসীন দলের মদদপুষ্ট একটি বাহিনী। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পিটায় তারা। এই দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। গত বৃহস্পতিবার আন্দোলনকারীরা ধানমন্ডি মডেল থানায় গিয়েছিল সেই হেলমেট বাহিনীর বিচার চাইতে। পুলিশের এক অংশ তাদের ভর্ৎসনা করে, অন্য অংশ জানতে চায়, চার বছর পর কেন অভিযোগ করতে চায়। উত্তরে ছাত্ররা বলে, বিচার হয়নি বলে তারা এসেছে।
শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি ধরে ধরে পর্যালোচনা করা হলে দেখা যাবে, প্রধান দাবিগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। একটি দফা ছিল গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত খবর বের হচ্ছে, দেশে এখনো গণপরিবহনে বিভিন্ন জায়গায় নারীরা ধর্ষণসহ নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া অন্যান্য অনিয়ম অরাজকতা নিয়মিত ঘটছে। এমনকি সড়কে যাত্রী ও পথচারীর প্রাণহানি আগের মতো রয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির মধ্যে ছিল ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধকরণ, চালকের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক, অতিরিক্ত যাত্রী বহন ও নির্ধারিত বেগের বেশি গতিতে গাড়ি চালানো যাবে না। ঈদের আগে-পরে ও সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনার দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে রাস্তায় দুর্ঘটনার মূল কারণ এসব দাবি পূরণ না হওয়া।
এ ছাড়া ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ, দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানে গতিরোধক নির্মাণ, যত্রতত্র গাড়ি থামানো বন্ধ, গাড়ি পুরোপুরি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামার দাবিগুলো খাতাকলমেই রয়ে গেছে।
তৎকালীন এক মন্ত্রী আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে অপমানকর কথা বলেছিলেন। তাকে তখন ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বিনয় দেখানো হয়নি। বরং হেলমেট বাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ছবি তুলতে গিয়ে সরকারের রোষানলে পড়েন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক শহিদুল আলম।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো। অনেক সময় দেখা যায়, গাড়িচালকরা পথে চলাচলরত যাত্রী কিংবা অন্য যানবাহনের নিরাপত্তা নিয়ে একেবারে গাফেল থাকেন। দায়ী চালকের বিরুদ্ধে কার্যকর শাস্তির দাবি ছিল আন্দোলনকারীদের। চার বছরে বহু মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলেও দায়ী চালকদের কারো উপযুক্ত শাস্তি হতে দেখা যায়নি। গাড়ি চালানো বাংলাদেশে একটি সহজ কাজ। অথচ এর সাথে মানুষের নিরাপত্তা জড়িত। ইচ্ছে করলেই যে কেউ পথে গাড়ি চালানো শুরু করতে পারেন। এ অবস্থা বন্ধ হওয়ার লক্ষণ নেই। রাস্তায় আইন ভঙ্গের জন্য ট্রাফিককে ঘুষ দিয়ে পার পাওয়া যায়। তাহলে কেন একজন ব্যক্তি কষ্ট করে গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নেবেন? কেনইবা তিনি অর্থ খরচ করে লাইসেন্স সংগ্রহ করবেন?
সড়কে নিরাপত্তাহীনতা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে বিশৃঙ্খলা রয়েছে এটি তারই একটি অংশ। সরকার বিষয়টি উপলব্ধি করবে বলে আমরা মনে করি।