সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্পর্ক এগিয়ে যাক

অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক হয়েছে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষ্যে ড. ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদি দুজনেই ব্যাংকক গিয়েছিলেন। সেখানেই আলাদাভাবে বৈঠকে বসেন তারা। তাদের এ বৈঠক সফল হয়েছে বলা যায় এবং এ সাফল্য আগামীদিনে দুদেশের সম্পর্কোন্নয়নে জোরালো ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। প্রসঙ্গত গত বছরের ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর দুদেশের সম্পর্ক অনেকটা শীতল হয়ে পড়েছিল। এই শীতল সম্পর্ক এখন থেকে উষ্ণ হবে, আশা করা যায়। আমরা মনে করি, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়ন কিংবা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনার বিকল্প নেই। বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘আলোচনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, গঙ্গার পানি চুক্তি নবায়ন, তিস্তা চুক্তির প্রসঙ্গ এসেছে। দুই শীর্ষ নেতার আলোচনা ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ হয়েছে।’
অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী মোদি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশে হিন্দুসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে দুই সরকারপ্রধানের বৈঠক হয়েছে বিশেষ পরিস্থিতিতে। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে একধরনের টানাপোড়েন চলছিল। বাংলাদেশের ক্ষমতার পালাবদল সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ বিষয় হওয়া সত্ত্বেও দিল্লির নীতিনির্ধারকেরা তা মানতে পারেননি। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ ও যাতায়াত জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ভারত পর্যটন ভিসা বন্ধ রেখেছে; মেডিকেল ভিসার ওপরও আরোপ করা হয়েছে কড়াকড়ি। বাংলাদেশ ও ভারত দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র। দুই দেশের মধ্যে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার স্থলসীমান্ত ছাড়াও আছে ৫৪টি অভিন্ন নদী। মোদি সরকারের আমলে স্থলসীমান্ত সমস্যার সমাধান হলেও অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি ২০২৬ সালে শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিলম্বে হলেও বাংলাদেশ ও ভারতের শীর্ষ পর্যায়ের এই বৈঠককে আমরা স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে এ কথাও মনে করি যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যে টানাপোড়েন চলছে, তা নিরসনে একটি বা দুটি বৈঠকই যথেষ্ট নয়। সর্বস্তরে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দুই সরকারপ্রধানের বৈঠকের তাগিদ দেয়া হয়েছিল আগে থেকেই। বিশেষ করে গত বছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে ঢাকা এই বৈঠকের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলো। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ককে অধিক গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেছেন। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের মানুষ তার কথার বাস্তবায়ন দেখতে চাইবে। ভারতের উদ্বেগের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা খোলাখুলি সেখানকার সাংবাদিকদের সরেজমিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। দিল্লির পক্ষ থেকে উসকানিমূলক বক্তব্য পরিহার করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এ ব্যাপারে ভারতেরও যথেষ্ট সচেতন হওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া ভারতে বসে শেখ হাসিনা যেসব উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন, তা যে এখানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করছে, সেটাও ভারতের নীতিনির্ধারকদের আমলে নিতে হবে।
এখানে আরও একটি বিষয় হচ্ছে, ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি ইউনূস-মোদি বৈঠক পরবর্তী বিশেষ প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, যেকোনো গণতন্ত্রে নিয়মিত অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন খুব জরুরি একটি ব্যাপার। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়েও প্রফেসর ইউনূসকে অবগত করেছেন। বিক্রম মিশ্রির এই বক্তব্যের সূত্রে বলা যায়, এর আগে বাংলাদেশে তিনটি নির্বাচনের দুটি পুরোপুরি একতরফাভাবে হলেও ভারতকে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলতে শোনা যায়নি। ভারতের এ ধরনের দ্বিমুখী অবস্থান বাংলাদেশে ভারতবিরোধিতা বাড়াতে সাহায্য করেছে।
দুই দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহল ইউনূস-মোদি বৈঠককে ইতিবাচক দৃষ্টিতে নিয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকের মধ্যে আশার আলো দেখার কথা বলেছেন। ভারতের কূটনৈতিক মহল মনে করে, বাংলাদেশ যাতে চীন ও পাকিস্তানের প্রতি আরও ঝুঁকে না যায়, সে জন্য দিল্লির কর্তব্য হবে ঢাকাকে আস্থায় নেওয়া।
আমরা মনে করি সমতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও ন্যায্যতার ভিত্তিতেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে হবে। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে কোনোভাবেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে টেনে আনা সমীচীন নয়। দেরিতে হলেও দুই দেশের সরকারপ্রধান মুখোমুখি বসে কথা বলেছেন। নিজেদের উদ্বেগ ও প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন। আশা করি, এখন বাকি কাজ উচ্চ কূটনৈতিক পর্যায়ে এগিয়ে নেয়া হবে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More