ঢাকার বড় সাতটি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনাটি শুধু অপ্রত্যাশিত ও দুঃখজনক নয়, সমস্যা জিইয়ে রাখলে সেটা পুঞ্জীভূত হয়ে কীভাবে সংকটের বৃত্ত তৈরি করে, তারই দৃষ্টান্ত। এক মাসের মধ্যে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরুসহ ৫ দফা দাবি জানিয়েছেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে আয়োজিত সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের ব্রিফিং থেকে এসব দাবি বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্তের জন্য ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন শিক্ষার্থীরা।
রোববার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্যের সঙ্গে সাত কলেজের শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের বাহাসকে কেন্দ্র করে এবারের ঘটনার সূত্রপাত। ঢাবির সহ-উপাচার্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছেন-এমন অভিযোগ তুলে কলেজ সাতটির কয়েকশ শিক্ষার্থী সন্ধ্যা থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা সায়েন্স ল্যাব মোড়ে সড়ক অবরোধ করে রাখেন। পরে রাত ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের দিকে এগোতে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যায়। দফায় দফায় সেই সংঘর্ষ চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। এ সময় দুইপক্ষের অন্তত দশজন আহত হন। সংঘাতের ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নাগরিকদের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে।
ঘটনার সময় দুইপক্ষ যেভাবে একে অন্যের দিকে লাঠিসোঁটা নিয়ে তেড়ে যায় এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে, সেটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হিসেবে কোনোভাবেই সংবেদনশীল আচরণ নয়। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা ধরে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে রাখলেন, তারপর সংঘাতে লিপ্ত হলেন; অথচ তাঁদের নিবৃত্ত করতে কিংবা বুঝিয়ে-শুনিয়ে ঘরে ফেরানোর ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষগুলোর দৃশ্যমান ভূমিকা দেখা যায়নি। এটা কোনোভাবেই দায়িত্বশীল আচরণ নয়।
পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই ২০১৭ সালে ঢাকার সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল। এ নিয়ে প্রথম থেকেই সংকটের বৃত্তে ঢুকে যান প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী ও হাজারের ওপর শিক্ষক। সমস্যাগুলো সমাধান না করায় এই সিদ্ধান্তের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হন এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষা, ফলাফল দেয়ার দাবিতে কিছুদিন পরপর তাদের রাস্তায় আন্দোলন করতে হয়েছে। নগরবাসীকেও এসব আন্দোলনের কারণে সীমাহীন দুর্ভোগ পোয়াতে হয়েছে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়।
এতো বড় একটা সংকট তৈরি হওয়ার পরও বিগত সরকারের আমলে সেটা সমাধান করা হয়নি। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর সাত কলেজ নিয়ে উদ্ভূত সংকট সমাধানের সুযোগ তৈরি হয়। গত কয়েক মাসে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা কয়েকবার আন্দোলনে নামেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অক্টোবর মাসে সাত কলেজের সমস্যা নিরসনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি করে। সর্বশেষ গত নভেম্বরে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করলে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ কলেজগুলোকে একটা আলাদা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার পরিকল্পনার কথা বলেন। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও কাজ করছে।
এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্যের সঙ্গে বাগ্বিত-ার জেরে এত বড় তুলকালাম ঘটে গেল, দায়িত্বপ্রাপ্তরা সংবেদনশীল আচরণ করলে সেটা এড়ানো সম্ভব হতো। এরই মধ্যে সোমবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাবির সহ-উপাচার্যের পদত্যাগসহ ছয় দফা দাবি জানিয়েছেন। ঢাবি উপাচার্য সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে আলোচনার পর জানিয়েছেন, কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে থাকছে না। আসন্ন ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে এসব কলেজে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে না।
আমরা মনে করি, এই সাত কলেজ নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেটা সমাধানে সরকার তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গতিশীল ও জোরালো ভূমিকা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদেরও মনে রাখা দরকার যে এটা আট বছরের পুঞ্জীভূত সংকট। ফলে তাড়াহুড়া করে নেয়া সিদ্ধান্ত আরও বড় কোনো ভুলের জন্ম দিতে পারে, যার ভুক্তভোগী তাদেরই হতে হবে। তাই সাত কলেজ সংকটের একটি যৌক্তিক সমাধান সবাই আশা করে।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.