পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, মুদ্রণ ও বিতরণ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) মূল কাজ হলেও এ কাজে প্রতিষ্ঠানটির দক্ষতা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এবার পুস্তক মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যাদেশের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিম্নমানের কাগজ-কালিতে বই ছেপে কোনো রকম বাঁধাই করে এনসিটিবির কাছে হস্তান্তর করেছে। এ বিষয়ক সামগ্রিক কর্মকা-ে দুর্নীতি হলেও এনসিটিবির দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে সোচ্চার হওয়ার ঘটনা বিরল। এনসিটিবি কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন শ্রেণির বই হাতে নিলে বোঝা যায়, এ প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বই ছাপাবিষয়ক ন্যূনতম অভিজ্ঞতাও নেই। যেহেতু বছরের পর বছর মানহীন বই প্রকাশিত হচ্ছে, এতে স্পষ্ট-পুস্তক মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে এনসিটিবির দুর্নীতিবাজদের যোগসাজশ রয়েছে। এ নিয়ে আলোচনা হলেও কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙে না কেন? সবকিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এনসিটিবির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশেষ সম্পর্ক আগামী দিনেও অটুট থাকবে। এতে একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি হবে।
অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্টদের অবহেলা ও তদারকির অভাবে পাঠ্যপুস্তক থেকে ভুল ও অসংগতি দূর হচ্ছে না। বিনামূল্যের পাঠ্যবই নিয়ে প্রতিবছরই নানারকম সমস্যা দেখা দিলেও এ বছরের সমস্যা অন্য বছরের তুলনায় গুরুতর।
লক্ষ্য করা যাচ্ছে, দায়সারা গোছের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হলেও এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তেমন কিছুই হয় না। এ দৃষ্টান্তে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেরাই বই ছাপার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এ উৎসাহের প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন করা দরকার। জানা যায়, প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবই নিজেরাই ছাপাতে চায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। যথাসময়ে পাঠ্যবই সরবরাহ, মুদ্রণ মান তদারকি ও নিশ্চিত এবং ভুলত্রুটিমুক্ত রাখার লক্ষ্যে এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সাম্প্রতিক এক বৈঠকে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নীতিগত সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সারসংক্ষেপ পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে এনসিটিবি পরিবর্তে নিজেরাই দরপত্র প্রক্রিয়া করে পাঠ্যবই মুদ্রণ করবে মন্ত্রণালয়। এজন্য এনসিটিবির আইনে পরিবর্তন আনতে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হবে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিজেই যখন কোনো কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব নিতে চায়, তখন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আন্তরিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ ধরনের অতি উৎসাহ শুভ লক্ষণ নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিজেই যদি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে মানুষের ভরসার কোনো জায়গা থাকে না। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, মুদ্রণ ও বিতরণে এনসিটিবি যাতে সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে, সেজন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। যে কোনোভাবেই হোক, শিক্ষার্থীদের হাতে নির্ভুল ও মানসম্মত বই তুলে দিতে হবে। সমন্বয়ের অভাব থাকলে তা সম্ভব হবে না। সব কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় করে শিক্ষার্থীদের হাতে নির্ভুল ও মানসম্মত বই সময়মতো পৌঁছে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি করে কেউ যাতে পার পেতে না পারে, তা-ও নিশ্চিত করতে হবে। যাদের গাফিলতির কারণে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, মুদ্রণ ও বিতরণে জটিলতা সৃষ্টি হয় তাদের যথাযথ জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার। বই উৎসবের কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করা কি এতই কঠিন? কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার কারণে প্রতিবছর শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ সময় হারিয়ে যায়। এর কি কোনো সমাধান নেই? শিক্ষার্থীদের হাতে নির্ভুল ও মানসম্মত বই সময়মতো পৌঁছে দিতে কর্তৃপক্ষকে পেশাদারি ও আন্তরিকতার পরিচয় দিতে হবে।