বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিগত ১৫ বছরে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও ব্যাপক দুর্নীতির কারণে সেগুলো উপযোগিতা হারিয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে এমন হতো না। রেলওয়েতে বিগত ১৫ বছরে রোলিং স্টক সংগ্রহে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে, ছোট-বড় ২৭ প্রকল্পে খরচ করা ওই অর্থের উল্লেখযোগ্য অংশই লোপাট হয়েছে। লোকোমোটিভগুলোর অর্ধেকের বেশি অকেজো, যেগুলো চলছে, সেগুলোর কাঙ্ক্ষিত গতি নেই, চলার সময় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কাজে আসছে না অনেক কোচ ও যন্ত্রাংশ। ওয়াশিং প্লান্টও পুরোপুরি অচল। দেশের খেটে খাওয়া মানুষের টাকা পানিতে পড়লেও ফুলেফেঁপে উঠেছেন অনেকে। লুটপাটের বিপুল অর্থ পাচার হয়েছে বিদেশেও। রেলওয়ের সব প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ ছিল পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে, আর দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন তার বোন শেখ রেহানা। ওই সময় প্রকল্পের অর্থ লুটপাটে ব্যস্ত ছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী থেকে প্রকল্প পরিচালক-সবাই। জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। রেলওয়ের তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মাত্র একজন মন্ত্রী কারাগারে রয়েছেন। রেলের তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য মন্ত্রীদের খোঁজ পাওয়া না গেলেও রেলওয়েতে তাদের দোসররা এখনো বহাল। বিস্ময়কর হলো, যেখানে ফ্যাসিস্টের দোসরদের শাস্তি হওয়ার কথা, সেখানে বরং তারাই হয়ে উঠেছেন হর্তাকর্তা। ফ্যাসিস্টের দোসর সাবেক প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি) অনেকে চলমান প্রকল্পেও দাদাগিরি করছেন, অনেকেরই হয়েছে পদোন্নতি। তাদের কেউ কেউ পেয়েছেন আরও লোভনীয় পদ-পদবি। এসব যাদের দেখার কথা, তারা কী করছেন? গত ১৫ বছরে রেলে প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অধিকাংশ প্রকল্পই নেয়া হয় শেখ হাসিনার নির্দেশে। কয়েকটিতে কোনো সমীক্ষাও করা হয়নি। কাজের ক্ষেত্রে ‘বিশেষজ্ঞ’ও নির্বাচন করা হতো রাজনৈতিক পরিচয়ে। ২০২১ সালে কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম থেকে দুই পর্বে ৩০টি লোকোমোটিভ কেনা হয়। এক্ষেত্রেও ভয়াবহ দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে দুদক। প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকায় কেনা লোকোমোটিভগুলোর লাইফটাইম ২০ বছর ধরা হলেও বছর না যেতেই ১১টি মেরামতের জন্য পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে যে ১৯টি লোকোমোটিভ চলছে, সেগুলোও মাঝেমধ্যেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একটি ‘লিফটিং জ্যাক’ (লাইনচ্যুত ট্রেনের চাকা রেললাইন উপরে তোলার যন্ত্র) ভারত থেকে আমদানি করলে খরচ পড়ে প্রায় ১৯ হাজার টাকা। কিন্তু এ যন্ত্র ঠিকাদারের কাছ থেকে রেলওয়ে কিনেছে ৩ লাখ টাকায়। এ রকম অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। রেলের প্রকল্পগুলোতে গত ১৫ বছরে সমীক্ষার নামে কী হয়েছিল, তা খতিয়ে দেখা দরকার। একনেকে এসব প্রকল্প অনুমোদনের জন্য কে বা কারা কী ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছিলেন, তাও খতিয়ে দেখার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার। রেলের ছোট-বড় সব দুর্নীতিবাজ এবং তাদের দোসরদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। এ সংস্থার সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে যথাযথ পদক্ষেপ।
পূর্ববর্তী পোস্ট
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.