প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগদান শেষে দেশে ফিরে এক বক্তব্যে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক যে মন্দাবস্থা চলছে, তাতে আগামী বছর বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষাবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানদের সাথে আলাপ কালে তারা এ আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। তেমন অবস্থা সৃষ্টি হলে বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়বে। তাই এ ব্যাপারে দেশবাসীকে আগাম প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বিগত বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি বৈশ্বিক মন্দাবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে চলেছেন। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর এ কথা বারবার বলার গুরুত্ব অনেক। আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে বলে তিনি বোঝাতে চান। খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সরকারের নীতিনির্ধারক ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সক্রিয় হওয়া জরুরি। বিশ্বে বা অন্যান্য দেশে কি হবে, সেদিকে না তাকিয়ে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চত করতে হবে।
যেকোনো দেশের মানুষের প্রথম মৌলিক নিরাপত্তা হচ্ছে, খাদ্যপণ্য নিশ্চিত করা। এর সাথে জাতীয় নিরাপত্তা জড়িয়ে আছে। মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করতে না পারলে বিভিন্ন ধরনের অরাজকতা ও অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। অভাব-অনটন ও ক্ষুধা মানুষকে হতাশ এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপরাধ প্রবণতার দিকে ঠেলে দেয়। বৈশ্বিক মন্দাবস্থাকে কেন্দ্র করে বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে অপরাধ বৃদ্ধির শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হলে তা সামাল দেয়া অত্যন্ত দুরুহ হয়ে দাঁড়াবে। ইতোমধ্যে আয়ারল্যান্ডভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড এবং জার্মানির ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফ যৌথভাবে বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক-২০২২ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ১২১টি দেশের ওপর করা সূচকে উল্লেখ করা হয়েছে, বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গত বছরের চেয়ে ৮ ধাপ নিচে নেমে গেছে। ৭৬তম অবস্থান থেকে এ বছর ৮৪তম অবস্থানে নেমেছে। অন্যদিকে, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্বে মারাত্মক খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হুমকিতে থাকা দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। এসব প্রতিবেদন নিশ্চিতভাবেই উদ্বেগের। বলার অপেক্ষা রাখে না, স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। হয়তো আরও এগিয়ে যাওয়া যেত। সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিগত কয়েক বছরে ধান-চালের বাম্পার ফলন হয়েছে। মাছ, গোশত, পোল্ট্রি, দুধ, শাক-সবজিতে সাফল্য এসেছে। দেশ মাছ উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। ডেইরি ফার্মের ব্যাপক বিস্তার লাভের কারণে গোশতের চাহিদা মিটেছে। দুধের উৎপাদন বেড়েছে। পোল্ট্রির বিস্তারে মুরগীর গোশত ও ডিমের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। ফল-ফলাদি ও শাক-সবজিও মানুষের প্রয়োজন মিটাতে সক্ষম হচ্ছে। এসব পণ্যের উৎপাদন আরো বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যর্থ হলে খাদ্যনিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে। এসব খাতের সাথে জড়িত কৃষক ও উৎপাদনকারীদের সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়াতে হবে এবং তাদের উৎপাদন সক্ষমতা ধরে রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহু আগে থেকেই দেশের প্রতি ইঞ্চি অনাবাদি জায়গায় খাদ্য উৎপাদনের কথা বলে আসছেন। দেশের মানুষের ক্রমবর্ধমান খাদ্যচাহিদা পূরণে এছাড়া বিকল্প নেই। এই সঙ্গে অন্যান্য খাদ্যপণ্য উৎপাদনে জোয়ার সৃষ্টি করতে হবে।
দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, খাদ্য উৎপাদন এবং নিরাপত্তাবিধানের সাথে জড়িত খাদ্য, কৃষি ও পানি মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে যতটা তৎপর হওয়ার কথা, ততটা দেখা যাচ্ছে না। তারা কি কাজ করছে, কি উদ্যোগ নিচ্ছে, তা দৃশ্যমান নয়। কেবল মুখে মুখে অনেক কথা বলছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতায় আত্মতৃপ্তি নিয়ে আছে। পরিস্থিতি যে দ্রুত বদলে যাচ্ছে এবং অবনতি ঘটছে-এ বিষয়টি খেয়াল করছে না। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে উদ্বেগ ও উদ্যোগ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের অনেকে দখলদারিত্বসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যে বারবার শঙ্কার কথা বলছেন, তা আমলে নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। অথচ বাস্তবিক ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি সতর্কবার্তা দিচ্ছেন। এ বার্তায় মন্ত্রী-এমপি, প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের হুঁশ হচ্ছে না। দেশের যতটুকু উন্নতি হয়েছে, তা যে ক্রমান্বয়ে নিম্নগামী এবং তা ঠেকাতে কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন, তা উপলব্ধি করছে না। বলা বাহুল্য, এখন ঘরহীনদের ঘর তৈরি করে দেয়ার চেয়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো অধিকতর জরুরি। প্রধানমন্ত্রীর সতর্ক বার্তা ও আশঙ্কা কৃষি, খাদ্য, পানি মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকলকে হৃদয়ঙ্গম করে দায়িত্ব নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তার শঙ্কাকে শক্তিতে পরিণত করতে হবে।