চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা, দেশবাসীর প্রার্থনা-সবকিছুকে ব্যর্থ করে দিয়ে মাগুরার আট বছরের কন্যাশিশুটি মৃত্যুর কাছে হেরে গেল। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে বৃহস্পতিবার বেলা একটায় শিশুটির মৃত্যু হয়। জীবন ও জগৎকে দেখার আগেই ছোট্ট নিষ্পাপ শিশুটিকে যে অবর্ণনীয় নির্মমতার মুখোমুখি হতে হয়েছে, সেটা এককথায় নারী ও শিশুর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দিতে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র যে চূড়ান্ত রকম ব্যর্থ, তারই রূঢ় প্রতিচ্ছবি। শিশুটির মৃত্যুতে খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা শোকাহত ও বিক্ষুব্ধ। কিন্তু এই শোক ও ক্ষোভকে আমরা যদি যৌক্তিক শক্তিতে পরিণত করে নারী ও শিশুর প্রতি, বিদ্বেষমূলক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচরণ বদলাতে না পারি এবং ভুক্তভোগীদের আইনি সুরক্ষা দিতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যতে এমন মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা ও শিথিলতার সুযোগে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতির মতো অপরাধের সঙ্গে নারী ও শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতনের মতো ঘটনাগুলো উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছিলো। জনপরিসরে, গণপরিবহনে নারীরা নানাভাবে হেনস্তা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছিলেন। ডিজিটাল পরিসরেও নারীবিদ্বেষী বক্তব্য হামেশাই আসছিলো। এমনকি মব তৈরি করে থানা থেকে নারী হেনস্তাকারীকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টাও আমরা দেখেছি। এ রকম অনেক ঘটনায় সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও দায়িত্বশীল কেউ কেউ যথেষ্ট দায়িত্বশীলতা ও সংবেদনশীলতার পরিচয় দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যখন নাজুক, সে রকম একটি বাস্তবতায় দায়িত্বশীলদের এমন ভূমিকা অপরাধীদের কি আশকারা দেয় না?
নারী ও শিশুর প্রতি একের পর এক সহিংসতার ঘটনায় খুব সংগত কারণেই নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছিলো। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ, বিক্ষোভও চলছিলো। এর মধ্যে মাগুরার শিশুটির ওপর ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুরতার খবর গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীসহ সারাদেশের মানুষ। প্রতিবাদের পরেই আমরা সরকারের টনক নড়তে দেখলাম। প্রকাশ্যে নারী হেনস্তার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হলো, ধর্ষণ মামলার বিচার ৯০ দিনে শেষ করতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করা হলো। মাগুরার শিশুটির মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি এই মামলার আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন। শিশুটির জন্য সারাদেশের মানুষ যেভাবে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন, সেটা নিঃসন্দেহে আশাজাগানিয়া। শিশুটির মৃত্যুর পর মানুষ যেভাবে শোক জানিয়েছেন, সেটাও বৃহত্তর সংহতিবোধের পরিচয়ের সাক্ষ্যবাহী। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একটা গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তী সরকার কেন প্রথম থেকেই নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে তাদের দৃঢ় অবস্থান জানাতে ব্যর্থ হলো? বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া আট বছরের শিশুটিকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছেন তার মা। এ মামলায় শিশুটির ভগ্নিপতি, বোনের শ্বশুর, শাশুড়ি ও ভাশুরকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। একমাত্র ন্যায়বিচারই এই নিষ্ঠুরতার জবাব হতে পারে। পুলিশের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, সারা দেশে যে ফৌজদারি অপরাধের ঘটনায় মামলা হয়, তার ১০শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা। যৌন নির্যাতন, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর খুনের শিকার হওয়ার অভিযোগে এসব মামলা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীদের শাস্তি হচ্ছে না। ২০২০ সালের গবেষণা বলছে, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে হওয়া মামলায় বিচারের হার শূন্য দশমিক ৪২ শতাংশ। এর পেছনে একটি বড় কারণ হলো রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতা। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিচারহীনতার এ ধারার অবসান না হলে ধর্ষণ, নির্যাতন প্রতিরোধ কতটা সম্ভব? মাগুরার শিশুটি আমাদের পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিচার বিভাগকে জেগে ওঠার সতর্ক ঘণ্টা শুনিয়েছে। আমরা কি সেটা শুনতে পাচ্ছি?
পূর্ববর্তী পোস্ট
পরবর্তী পোস্ট
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.