নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমাদের মধ্যে হাজির হয়েছে আরও একটি নতুন বছর। পুরোনোকে বিদায় জানিয়ে আগমন ঘটেছে নতুন বছরের। আজ বাংলা ১৪৩২ সনের প্রথম দিন, পয়লা বৈশাখ। আগের বছর ১৪৩১ কেটেছে মন্দ ও ভালোর মিশ্রণে। বিশেষ করে ফ্যাসিবাদের একেবারে শেষ সময়গুলোতে জাতি ঘোরতর পীড়নে পিষ্ট হয়েছে। শুধু ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়া হয়েছে। মুক্তির আকাক্সক্ষী মানুষ বুক দিয়ে হাসিনার দানবীয় শাসন পরাস্ত করেছে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে আমাদের জাতীয় জীবনে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। আজকের সূর্য উদিত হয়েছে আরেক নতুন সম্ভাবনার আকাক্সক্ষা নিয়ে। পয়লা বৈশাখ আমাদের জাতীয় জীবনে নববর্ষের সংগ্রামী আমেজ সৃষ্টি করে। একটি উৎসবমুখর উদযাপনের দিন এটি। এর মধ্যে ঐতিহ্যগত রেওয়াজ ও লোকজ সংস্কৃতির কিছু রূপময়তা ফুটে ওঠে। এদিন সব বয়সী মানুষকে আনন্দে উদ্বেলিত হতে দেখা যায়। আমাদের জনজীবনে আজও দেশীয় বা বাংলা পঞ্জিকা নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটি বাংলার প্রকৃতি, লোকসংস্কৃতি, জলবায়ু ও জীবনযাত্রার সাথে ঘনিষ্ঠ। বাংলা বর্ষপঞ্জি অতীতে ‘ফসলি সন’ হিসেবে পরিচিত ছিলো। এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করে আনন্দ শোভাযাত্রা দিয়ে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নববর্ষ পালনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক বাঙালি, উৎসবপাগল বাঙালি এসব উপেক্ষা করে এবারও উল্লাসে ফেটে পড়বে।
উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার নব-উন্মেষকালে ছায়ানট সেই যে কাকডাকা ভোরে রবীন্দ্রনাথের নববর্ষ বরণের আবাহনী গান গেয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলো, সেটিই রাজধানীবাসীর সবচেয়ে বড় উৎসবের কেন্দ্র। মোগল সম্রাট আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায়, সৌরসনের সাথে মিল রেখে হিজরি পঞ্জিকার ভিত্তিতে বাংলা সন বা বর্ষ গণনার রীতি চালু করা হয় জনগণের কৃষিকাজ তথা অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটানোর স্বার্থে। বিভিন্ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে বাংলা সন বাস্তবোচিত ও বিজ্ঞানসম্মত একটি পঞ্জিকার মর্যাদা পেয়েছে। পঞ্জিকা হিসেবে একে টেকসই করতে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। লিপইয়ারসহ বাংলা সন এখন তাই সুনির্ধারিত, যা আন্তর্জাতিক বর্ষপঞ্জির সাথে চমৎকার সাযুজ্য তৈরি করেছে। হালখাতা, অর্থাৎ পুরনো হিসাবকে হালনাগাদ করার রেওয়াজ থেকে পয়লা বৈশাখের দিনে নববর্ষ পালনের তাগিদ এলেও এটি আর সেখানে সীমাবদ্ধ নেই। পয়লা বৈশাখ উদযাপন আমাদের সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে বিভিন্নভাবে এবং সাধারণ মানুষকে শেকড়ে ফিরতে অনুপ্রাণিত করেছে। কৃষিজীবী মানুষকে সম্পূর্ণভাবে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হলে এর বৈচিত্র্য ও আকর্ষণ আরো বাড়বে। নগরজীবনের অসহ বিড়ম্বনায় একটু স্বস্তি পেতে শহুরে মানুষেরা পয়লা বৈশাখ পালনের তাগিদ অনুভব করেছে। এ ক্ষেত্রে ঐতিহ্যের সাথে কিছু আরোপিত অপসংস্কৃতির প্রলেপ দেয়া হচ্ছে। অথচ এসবের সাথে কৃষিভিত্তিক গ্রামবাংলার গণমানুষের সম্পর্ক নেই। নাগরিকদের বিভক্ত করে শাসন ও শোষণ করার অপচেষ্টা এদেশে আমরা দেখেছি। বিশেষ করে বিগত দেড় যুগ আমাদের ওপর এক অশুভ শাসন চাপানো হয়েছিল। এ অবস্থায় বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশের মানুষের মেলবন্ধনে আরো জোরালো একটি সূত্র হিসেবে কার্যকর হতে পারে। ‘একতাই বল’ এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হতে এটি হতে পারে শক্তিশালী একটি সাংস্কৃতিক উপাদান। আমরা চাই, দেশ ও জাতির মঙ্গলে সবার ভেতরে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত দেশপ্রেম জাগ্রত হোক, খুলে যাক সম্ভাবনার নতুন দুয়ার-মানুষ বেঁচে থাকুক, বাঙালি বেঁচে থাকুক সমহিমা নিয়ে। নতুন বছরে এ প্রত্যাশাই করছি। দুঃখ-গ্লানি, অতীতের ব্যর্থতা পেছনে ফেলে তাই এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেয়ার দিন পয়লা বোশেখ। নতুন বছর সবার জন্য মঙ্গল বয়ে আনুক। দেশের সবার কল্যাণ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনুক। মানুষ বেঁচে থাকুক বিপুল আনন্দ ও অপার সম্ভাবনা নিয়ে। মঙ্গল হোক সবার। সবাইকে নতুন বছরের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।
পূর্ববর্তী পোস্ট
পরবর্তী পোস্ট
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.