দুই স্তরের শিক্ষায় উপেক্ষিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ

সম্পাদকীয়

দেশের মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা নানামুখী সংকটের মধ্যদিয়ে চলছে, যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা শিক্ষা বিভাগের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো তা স্বীকার করতে চাইছে না। তারা যখন যেটি করছেন, সেটাকেই অতি উত্তম ভাবছেন। শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকদের আপত্তি উপেক্ষা করে শিক্ষা বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ওপর বার্ষিক পাবলিক পরীক্ষা চাপিয়ে দিয়েছিলেন। এতে শিক্ষার্থীদের কোনো লাভ না হলেও কোচিং-বাণিজ্য ও নোট-গাইড বিক্রেতাদের ব্যবসার প্রসার ঘটেছে। অতি সম্প্রতি সরকার পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা বাদ দিলেও পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা রেখে দিয়েছে, যার ফল প্রকাশ নিয়ে এবার কেলেঙ্কারিও হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষক-স্বল্পতা, সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই না পৌঁছানো, বিদ্যালয়ে শিক্ষার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকা শিক্ষার্থীদের ‘ভাগ্যলিখন’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে আরও দুটি বড় সমস্যা ও সমন্বয়হীনতার কথা জানা গেল। একটি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণগত, আরেকটি দুর্বল শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশেষ নজর না দেয়া। দেশের ১৪৫টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক স্তরে পাঠদানের ব্যবস্থা থাকলেও সেই স্তরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই। নেই প্রাথমিক শিক্ষার জন্য আলাদা শিক্ষকও। এর মধ্যে ১০টি বিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিকও (একাদশ ও দ্বাদশ) চালু আছে। এসব বিদ্যালয়ে যারা শিক্ষক হয়ে আসেন, তারা সবাই মাধ্যমিক স্তরের। দুই স্তরের পাঠদান পদ্ধতিতে ফারাক আছে। শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, এসব মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কীভাবে প্রাথমিক শিক্ষা যুক্ত হলো, তা তারা জানেন না। এ বিষয়ে মাউশিতে কোনো নথিপত্রও নেই। বেশ কয়েকটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মাউশির কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন, বর্তমানে যেভাবে এ শিক্ষা কার্যক্রম চলছে, তা কোনোভাবে ভালো নয়। এভাবে মানসম্মত শিক্ষা সম্ভব নয়।

অন্যদিকে মাউশির পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখার একটি প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজিতে দুর্বল। একই শ্রেণিতে গণিতে ৪৩ শতাংশের অবস্থা খারাপ বা গড়পড়তা। কোচিং ও প্রাইভেটের পেছনে সচ্ছল পরিবারগুলো বাড়তি ব্যয় করতে পারে। কিন্তু নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো পারে না। ফলে শিক্ষায় বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে ব্যয়ের ৭১ শতাংশই বহন করতে হচ্ছে পরিবারগুলোকে। এতে এ সত্যই বেরিয়ে এলো যে সরকার শিক্ষা নিয়ে ঢাকঢোল পেটালেও এ খাতে অবদান খুব বেশি নয়। শিক্ষা ব্যয়ের সিংহভাগ বহন করতে হয় অভিভাবককে। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দের হার কম।

সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রাথমিক স্তরে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করতে হবে। মাধ্যমিক স্তরের প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রাথমিক স্তরে যে ভালো পড়ানো যায় না, সেটা শিক্ষা বিভাগের অভিভাবকদের বুঝতে হবে। একইভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীদের প্রতি বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে শ্রেণিকক্ষেই। শ্রেণিকক্ষের বাইরে কোচিং ও নোট-গাইড ব্যবসাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।

মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্ষেত্রে দুই মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদপ্তরের যে দ্বৈত শাসন চলছে, তারও অবসান ঘটাতে হবে। শিক্ষার্থীদের যারা পড়াবেন, তাদের মানসম্মত প্রশিক্ষণের বিষয়টি কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More