ক্ষুধার্ত মানুষ বাড়ছে : পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কা

সম্পাদকীয়

অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা থেকে সৃষ্ট সঙ্কট মানুষের দৈনন্দিন জীবন চরম দুর্বিষহ করে তুলেছে। প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। জনসংখ্যার বিশাল অংশ দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত। এদের পক্ষে সব সাধ আহ্লাদ ত্যাগ করে শুধু দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকাও সম্ভব হচ্ছে না। এর মধ্যে খোদ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আগামী বছর দেশে আরো অর্থনৈতিক দূরবস্থায় পড়তে যাচ্ছে। এ অবস্থায় মানুষের মধ্যে শঙ্কাভীতি আরো বেড়ে চলেছে।

আয়ারল্যান্ডভিত্তিক মানবিক সংস্থা কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড ও জার্মানিভিত্তিক ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফ যৌথভাবে গত বৃহস্পতিবার বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক-২০২২ প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, এ সূচকে বাংলাদেশের ধারাবাহিকভাবে অবনতি ঘটছে। এবার ১২১টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ৮৪। ২০২১ সালে ৭৬তম ও ২০২০ সালে আমরা ৭৫তম অবস্থানে ছিলাম। সামনে এ সূচকে আমাদের অবস্থার যে আরো অবনতি হবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কারণ সূচকটি তৈরি হয় দেশের সম্পদ বণ্টনকে গুরুত্ব দিয়ে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা উন্নয়নের নতুন যে গণতন্ত্র চালু করেছে তাতে শুধু একটি শ্রেণী ফুলে ফেঁপে কলাগাছ হয়েছে। সম্পদের একমুখী বিপুল প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে। রোগগ্রস্ত মানুষের চেহারায় রক্ত জমে যেমনটি হয়; আমাদের অর্থনীতিও কিছু মানুষকে বিপুল অর্থের মালিক করেছে। এটি বিপরীতক্রমে বিপুল দরিদ্র ক্ষুধার্ত শ্রেণীর জন্ম দিয়েছে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।

বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমাদের অবস্থার অবনতির জন্য দায়ী নিত্যপণ্যের অতিরিক্ত দাম। অপুষ্টি, পাঁচ বছরের শিশুদের উচ্চতা, উচ্চতার তুলনায় ওজন ও মৃত্যুহার বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক তৈরিতে এ চারটি চলক ব্যবহার করা হয়। করোনা মহামারীর পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির দুরবস্থা শুরু হয়। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন শুরু হয়। তবে এগুলোকে ছাপিয়ে এখন অর্থনীতির অব্যবস্থাপনা সব কিছুকে গ্রাস করে নিচ্ছে, যা আমাদের অভ্যন্তরীণ অনিয়ম থেকে সৃষ্ট। মূলত দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাধর প্রভাবশালী গোষ্ঠী অর্থনীতিকে ফোকলা করে ফেলেছে। ব্যাংকসহ পুরো আর্থিক খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ অথবা লোপাট করা হয়েছে। খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এ দুর্নীতিবাজদের থেকে রেহাই পায়নি। এর সাথে উন্নয়ন প্রকল্প বেশুমার লুটপাট ও সরকারি খাতের ঘুষ দুর্নীতি মহামারী আকারে চলেছে। বিপুল অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়ে বাইরে চলে গেছে। মুদ্রামানের পতনের মধ্যে দিয়ে তারই প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের অর্থনীতিতে।

বৈশ্বিক ক্ষুধা প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় গুরুতর ক্ষুধা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আফ্রিকার সাহারা অঞ্চল ও পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোর কাতারে আমরা রয়েছি। দুর্নীতির বিপুল অভিঘাতের পাশাপাশি বাড়তি যোগ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুরবস্থা। প্রতি বছর উপকূলীয় অঞ্চলে হানা দিচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে লোনা পানিতে। এতে মানুষ ঘরবাড়ি হারাচ্ছে, ফসল উৎপাদন কমছে। মহামারী ও যুদ্ধবিগ্রহ পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করছে। আফ্রিকার সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর কাতারে তাই আমরা শামিল হচ্ছি।

করোনার প্রথম আঘাতের সময়ে জরিপে দেখা গেছে, দারিদ্র্য সূচকে দুই দশকে আমরা যে উন্নতি করেছিলাম সেটি আগের জায়গায় ফিরে গেছে। গত তিন বছরে পরিস্থিতি তা থেকে উন্নতি ঘটেনি। এ অবস্থায় এসে আমাদের কাছে তড়িঘড়ি অর্থনৈতিক উন্নতি করার আশাপ্রদ খবর নেই। শুধু ক্ষুধা সূচকে অবনতি নয়, আমাদের রাজনৈতিক সামাজিক শৃঙ্খলার মধ্যে বড়দাগে ফাটল ধরেছে। অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সামাজিক স্থিতিশীলতা দরকার। দেশে সে ধরনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাই সামনে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা আরো বৃদ্ধির শঙ্কা দেখা যাচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বোধোদয় প্রয়োজন। ক্ষমতাসীনদের মধ্যে যা এখনো দেখা যাচ্ছে না।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More