তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ও বিপুল সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দেশে আলোচিত হচ্ছে ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে। কারণ বাংলাদেশ ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থিত।
বঙ্গোপসাগরে ভূমিকম্পের চারটি সক্রিয় উৎস আছে। এগুলোতে যেকোনো সময় রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার বেশি কম্পন সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের মধ্যে রয়েছে পাঁচটি ভূতাত্ত্বিক ফল্ট লাইন, যা বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটানোর মতো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সীমানায় অবস্থান করছে। তার ওপর এটি সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি বিশ্বের বৃহত্তম নদী ব-দ্বীপের শীর্ষে অবস্থিত, ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ঝুঁকি ও ভূমিকম্পের পর সুনামি এবং বন্যার ঝুঁকি উভয়ের মুখোমুখি হতে পারে। বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের টেকটোনিক কাঠামো নির্দেশ করে, এদেশ ভারত ও ইউরেশিয়ার প্লেট মার্জিনের সংলগ্ন, যেখানে অতীতে বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়েছে।
বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে ভূমিকম্প সৃষ্টিকারী বেশ কয়েকটি টেকটোনিক ব্লকে বেষ্টিত। বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম বড় কোনো ভূমিকম্প দেখেনি বলে তারা ভূমিকম্পের ঝুঁকি সম্পর্কে সাধারণভাবে তেমন কিছু জানে না। তবে গত সাত-আট বছরে দেশের অভ্যন্তরে বা দেশের সীমান্তের কাছাকাছি ৪ থেকে ৬ মাত্রার মধ্যে কিছু ভূমিকম্পের ঘটনা ও ক্ষতি সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, দেশে যেকোনো সময় মাঝারি থেকে ভারী ভূ-কম্পনে গুরুতর মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। সাম্প্রতিক পুনরাবৃত্ত নিম্ন থেকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পকে অদূর ভবিষ্যতে সম্ভাব্য একটি বিপর্যয়কর ভূমিকম্পের আগাম সতর্কতা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে এ কম্পনগুলো ফল্ট ফাটল জোনের মধ্যে জমা হওয়া বেশির ভাগ চাপ মূক্তি দিতে ব্যর্থ হয়।
ভূতাত্ত্বিক জরিপ রেকর্ডের তথ্যমতে, দেশে ১৯৭১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৪৬৫টি ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ, বড় শহরে রিখটার স্কেলে ৭.০ মাত্রার ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশে সঠিক নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার না করায় এবং বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করে নগর কেন্দ্রগুলোতে নির্মিত অনেক ভবনের কাঠামোগত দুর্বলতা থাকায় বড় মানবিক বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক ক্ষতি ঘটতে পারে। দেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প মোকাবেলার পূর্বপ্রস্তুতি খুবই দুর্বল। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতায় এমনটি হয়েছে। বড় ধরনের ভূমিকম্প-পরবর্তী বিপর্যয় কীভাবে মোকাবেলা করা যায়; সে সম্পর্কে দেশের মানুষের সচেতনতাও কম। অভাব রয়েছে উন্নত ফায়ার ব্রিগেড ও সিভিল ডিফেন্স কার্যক্রম সহায়তা সুবিধার, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের থাকার জন্য মাল্টিডিসিপ্লিনারি হাসপাতাল, শারীরিক ও মানসিক সহায়তা, অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে যোগাযোগ, পরিবহন যান, পর্যাপ্ত সংখ্যক ড্রিলিং সরঞ্জাম, বুলডোজার ইত্যাদিরও অভাব আছে। তাই দেশে একটি বড় ভূমিকম্প আঘাত হানলে জীবন ও সম্পত্তির যে বিপর্যয় এবং ক্ষতির সৃষ্টি করবে তা হবে কল্পনাতীত।
তবে দেশের ভূপ্রকৃতির যে গঠন তা কয়েকটি প্লেটের সমন্বয়। সে দিক থেকে বিবেচনা করলে আমাদের ভূপ্রকৃতির গঠন অতোটা শক্ত নয়। যার ফলে দেশে ভূমিকম্প হলে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে কিছুটা সময় লাগবে বলে ভূকম্প-বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এটি একটি ভালো দিক। তবে উন্নত বিশ্বে যেমন যেকোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি থাকে; আমাদেরও এ রকম দুর্যোগে পড়ার আগে ব্যাপক প্রস্তুতি রাখতে হবে। প্রস্তুতির বিকল্প কিছু নেই। সর্বোপরি জাতীয় বিল্ডিং কোড ও সক্ষমতা বৃদ্ধির যথাযথ প্রয়োগ দেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে পারে। ভূমিকম্প সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে গণসচেতনতা, ভূমিকম্প হলে কী করতে হবে, কোথায় আশ্রয় নিতে হবে, সাহায্য পেতে কোথায় যোগাযোগ করতে হবে- ইত্যাদি নিয়মিত গণমাধ্যমে প্রচার করা উচিত।